২৪ না ২৫? তাঁর ‘ইংরেজি’ জন্মদিন নিয়ে অনেকেই ধন্দে থাকেন। ওপার বাংলায় ২৫ মে তাঁর জন্মদিন পালন করা হলেও আদতে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ২৪ মে, এ বিষয়টি তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকেই একাধিকবার সংশোধিত হয়েছে। আবার, বাংলা সাল অনুসারে তাঁর জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ, পশ্চিমবাংলায় এইদিনেই মূলত পালিত হয় তাঁর জন্মদিন। হ্যাঁ, আজই সেই দিন; আজ সেই অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব- প্রেম, প্রতিবাদ ও সাম্যবাদের কবি-সঙ্গীতজ্ঞ 'দুঃখু মিঞা' ওরফে কাজী নজরুল ইসলামের ১২০ তম জন্মদিন।
সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার ঘেরাটোপে জন্ম তাঁর। গর্ভেই পর পর চারটি সন্তান মারা যাওয়ার পর মায়ের কোল আর গরিবের সংসার আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন 'দুঃখু মিঞা' ওরফে কাজী নজরুল ইসলাম। শুধু তাই নয় ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে, ১১ জৈষ্ঠ ভূমিষ্ঠ হওয়া সেই সন্তান আলোকিত করেছিলেন বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের কাজী পরিবার সহ বাংলা তথা সমগ্র দেশের সাহিত্য-সুরের জগতকে।
৯ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সেই বয়সেই সংসারের দায়ভার নিয়ে, দারিদ্রকে গভীরভাবে অনুভব করে দুঃখু মিঞার মনে জন্ম নিয়েছিল বৈরাগী ভাব। ভবঘুরে হয়ে ছোট থেকেই সঙ্গ করতে শুরু করেন কবিয়াল, বাউল, সুফী, দরবেশী, সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে। স্কুলে গিয়ে সেভাবে পড়বার সুযোগ হয়নি তাঁর, কিন্তু সঙ্গগুনে তিনি ছোট ব্যসেই আয়ত্ত করেছিলেন সাহিত্য ভাষা, উর্দু, ফারসী, বেদ, পুরান সবই। কিশোর অবস্থাতেই লেখালিখি আর গানের প্রতি নিষ্ঠা তৈরী হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে তখন যুদ্ধ, দশম শ্রেনীতে পড়াকালীন ১৯১৭ সালে যোগ দেন বাঙালী যুবক সেনাদলে, স্কুল পালিয়ে যুদ্ধেও যান তিনি। ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ গ্রন্থের ভূমিকায় স্মৃতিচারণ করে নজরুল লিখেছেন, “আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি সে আজ ইংরাজী ১৯১৭ সালের কথা, সেইখানে সর্বপ্রথম আমার হাফিজের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালী পলটনে একজন পাঞ্জাবী মৌলবী সাহেব থাকতেন, তার কাজে ক্রমে ফরাসী সমস্ত বিখ্যাত কাব্য পড়া শেষ করে ফেললুম”।
যুদ্ধশেষে কলকাতায় ফিরে এসেই লিখে ফেলেছিলেন- 'বল বীর- বল উন্নত মম শির'-এর শব্দ ঝংকার তোলা 'বিদ্রোহী' কবিতা। এই কবিতার জন্য তিনি পান সার্বজনীন স্বীকৃতি পান, এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবি প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘বসন্ত’ নাটকটি তাঁকে উৎসর্গ করেন, আশীর্বাদ করে লিখে পাঠান- ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নি সেতু/ দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/ অলক্ষণের তিলক রেখা/ রাতের ভালে হোকনা লেখা/ আছে যারা অর্ধ চেতন।‘
এভাবেই বিদ্রোহী অবতারে প্রকাশ্যে এসেছিলেন তিনি, তারপর একে একে আসে অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা, সাম্যবাদী, ফনী-মনসা, সাতভাই চম্পা, ,নির্ঝ্র, সঞ্চয়ন, যুগবানী, খুকি ও কাঠবেড়ালি, ঝিঙ্গে ফুল, দুর্দিনের যাত্রী , রুদ্র মঙ্গল, ধূমকেতু, আনন্দময়ীর আগমনে, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা -একাধিক কবিতা, ছোটদের জন্য ছড়া-গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, প্রবন্ধ, কাব্যগ্রন্থ।
নজরুল তাঁর কাব্য ও সঙ্গীত রচনায় যেমন বিভিন্ন বৈচিত্র্যের উদঘাটন করেছেন তেমনি শিশুদের জন্যও সাহিত্য, ছড়ায় রেখেছেন উপযোগী স্বাক্ষর। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর ‘খুকি ও কাঠবিড়ালি’ নিয়ে একটি ছোট গল্প রয়েছে। কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লাতে। একদিন কবি দেখতে পান যে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের শিশু কন্যা জটু(ভালো নাম অঞ্জলী সেন) একা একা কাঠবেড়ালির সঙ্গে কথা বলছে। সে দৃশয় দেখেই এ কবিতাটি রচিত। এই কবিতার ‘রাঙা দিদি’ হচ্ছেন প্রমীলা সেনগুপ্ত, তাঁর স্ত্রী। শিশুর মত সরল এবং উৎসাহী মন ছিল বলেই শিশুমনে তাঁর লেখা সহজভাবে প্রকাশ হতে পেরেছে।
নজরুল বিশ্বাস করতেন যে কবিরাই হচ্ছে নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণের একমাত্র মুখপাত্র এবং সে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনিও। ...মানুষের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম তাই তিনি মানুষের জাগরণে সোচ্চার হয়ে উঠতে কোনও দিনই ক্লান্তি বোধ করেননি। দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন ফলে নজরুলের কাব্য ‘শৌখন রচনা’ হয়ে ওঠেনি, যেকারনে কবিতা লেখার অপরাধে এক বৎসর কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল তাঁকে। অনমনীয় বিদ্রোহ নজরুলের কন্ঠে কারাগারেও সোচ্চার হয়েছিল, গাইলেন, ভাঙার গান- ‘কারার ওই লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট/রক্ত জমাট, শিকল পূজার পাষাণ বেদী।‘ চারণ কবির ভূমিকা নিয়ে তাঁর গান ও সুরের মাধ্যমে ঘুম ভাঙিয়েছিলেন চাষী, মজুর, জেলে সর্বস্তরের মানুষদের। তাঁর কাব্য-মুক্তিমন্ত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), ‘বিষের বাঁশি’ (১৯২৪), ‘প্রলয় শিখা’ (১৯৩০)। কারাগারে বসেই সুর তুলতেন প্রাচীরভেদী রুদ্রবীণায়।
১৯২৯ সালে কবির ৩০ বছর বয়সে জাতির পক্ষ থেকে তাঁকে সম্বর্ধনা জানানোর সময় সুভাষ চন্দ্র বসু বলেন- “স্বাধীন দেশে জীবনের সাথে সাহিত্যের স্পষ্ট যোগ আছে। আমাদের দেশে তা নেই। দেশ পরাধীন বলে এ দেশের লোকেরা জীবনের সকল ঘটনা থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে পারে না। নজরুল তাঁর ব্যতিক্রম দেখা যায়। তাঁর লেখার প্রভাব অসাধারণ। তাঁর গান পড়ে আমার মত বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গাইবার ইচ্ছা হত। আমাদের প্রান নেই, তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারিনা। নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়, এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা বিদ্রোহী তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তার গান গাইব।“
রবীন্দ্রনাথকে তিনি গুরুদেব মানতেন। রবীন্দ্রনাথের পরে গীতিকার ও সুরকারদের মধ্যে কাজী নজরুল এবং নজরুলগীতি মানুষের মনকে নাড়া দিতে পেরেছিল সবচেয়ে বেশী। তাঁর লেখায়-সুরে 'কারার ঐ লৌহকপাট'-এর মতো বিপ্লবী মেজাজের পাশাপাশি অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে 'আমার কালো মেয়ের পায়ের তলা'র মতো শ্যামাসঙ্গীতও। ছেলে বুলবুলের অকাল মৃত্যু, স্ত্রী প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে চির শয্যাগতা, এইসময় তাঁর মনে আধ্যাত্মিক ভাবের প্রকাশ ঘটে। ছোট বেলায় সুফী ফকীর দরবেশদের সঙ্গ করার অভ্যাস আবার তার ভিতরে প্রতিষ্ঠা পায়। তন্ত্রসাধনায় মনোনিবেশ করেন, দীক্ষা নেন সাধক বরদা চরণ মজুমদারের কাছে। রুদ্ধকক্ষে দিনের পর দিন যোগধ্যান করতে শুরু করেন, তারপর পরই শ্যামাসঙ্গীতে তাঁর মন মজে। তাঁর শ্যামাসঙ্গীতসমূহ উচ্চমার্গের সাধকতুল্য ভক্তিরসাশ্রিত তন্ত্র সাধন সম্পৃক্ত রচনা।
ভারত সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন 'পদ্মভূষণ সম্মান', বাংলাদেশ তাঁকে দিয়েছে জাতীয় কবির মর্যাদা। একজন প্রকৃত দার্শনিকের মতই তাঁর কলমে বারবার উচ্চারিত হয়েছে সাম্যবাদের কথা- 'গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।'
অনড় প্রতিবাদী স্বভাবের জন্য সমাজের কাছে বারবার লাঞ্ছিত হয়েছেন, প্রশ্রয় দিতেন না মানবতাবিরোধী সামাজিক-ধর্মীয় গোঁড়ামি কে, প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন বলে সমাজ তাঁদের 'একঘরে' করে দেয়। তবু আজীবন নিজের স্বতন্ত্র মত প্রকাশে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করতেন না। জীবন দর্শনের মধ্য দিয়ে তিনি আরাধনা করতেন সকল ধর্মের আধ্যাত্মিক চেতনাকে। শেষ জীবনও সম্মুখীন হয়েছিলেন অর্থাভাবের। বয়সকালে শরীরে কোনো সাড় ছিল না তাঁর, পক্ষাঘাত একেবারে পঙ্গু করে ছেড়েছিল তাঁকে। তবু শেষ নিঃশ্বাস অবধি জ্বল জ্বল করত তাঁর চোখ, যে চোখে আজীবন তিনি দেখেছিলেন বিরোধ-হিংসা নয়, প্রেম, মানবতা আর সাম্যের স্বপ্ন।