দেবী কৌশিকীর নাম থেকেই 'কৌশিকী অমাবস্যা'-র নামকরণ হয়েছে। কিন্তু, সেই নামকরণ হল কীভাবে, দেবী-ই বা আবির্ভুত হলেন কীভাবে--সে গল্পই আজ শোনাব বেদব্যাস রচিত 'মার্কণ্ডেয় পুরাণ'-থেকে :
শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুর-ভাই ছিল। তারা দুরন্ত, দুর্দান্ত এবং ভয়ঙ্কর। তাদের একদিন সাধ হল অমর হতে হবে এবং ত্রিলোকের রাজা হতে হবে। ব্যস, যেমন ভাবা তেমন কাজ, বসে পড়ল তপস্যায়। ব্রহ্মা হচ্ছেন সবচেয়ে নিরীহ দেবতা। ফলে, সরাসরি তাঁকে পাকড়াও করার সাধনাই তারা শুরু করল। অসুরেরা যা করে মনপ্রাণ দিয়েই করে, কঠোর-কঠিনভাবে করে। তপস্যাও তেমনভাবেই করল। কাজেই, ব্রহ্মাকে ছুটে আসতে হল বর দিতে। কিন্তু, অমরত্বের প্রার্থনা শুনে ব্রহ্মাকেও পিছু হঠতে হল। সে বর দেওয়া তো সম্ভব নয়! তবে ব্রহ্মা তাদের বললেন যে, কোন পুরুষের হাতে কিছুতেই তাদের মৃত্যু হবে না, তাদের মৃত্যু হবে কেবল কোন এক নারীর হাতে। ব্যস, দুই ভাই এতেই বাগ বাগ খুশি হয়ে গেল। তারা যেরকম ধুরন্ধর যোদ্ধা তাতে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি কিংবা সাহস কোন নারীর আছে নাকি ত্রিলোকে! কারও নেই। তার মানে, তাদের মৃত্যুও নেই। অমরত্বের তাহলে আর বাকি রইল কী! কিচ্ছু না। এ-কথা ভেবেই আত্মতুষ্টিতে দুই ভাইয়ের অট্টহাসি যেন আর ধরে না।
বরলাভ হয়ে গেছে আর কী! মহর্ষি ভৃগুকে ডাকিয়ে কপালে রাজতিলক আঁকিয়ে রণহুংকার দিতে দিতে চণ্ড-মুণ্ড-রক্তবীজদের মতো দুর্ধর্ষ সেনাপতিদের জুটিয়ে বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে শুম্ভ-নিশুম্ভ হামলা করল ত্রিলোকে। পাতাল ও মর্ত্যে তাদের বাধা দেবার মতো কেউ ছিল না; স্বর্গের দেবতারা খানিক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু ব্রহ্মার বরে বলীয়ান অসুরদের ঠেকাতে পারলেন না। স্বর্গ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন তাঁরা। ব্যস, আর কী, শুম্ভ-নিশুম্ভ ত্রিলোকের রাজা হয়ে গেল। শুরু হল ত্রিলোকে তাদের আসুরিক অত্যাচার। অল্পদিনেই সেই অত্যাচারে সবাই একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। দেবতারাও আর পারলেন না। তাঁরা এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য ব্রহ্মার পরামর্শে দেবী মহামায়ার স্তব শুরু করলেন।
সেদিন ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথি। দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে আবির্ভুত হলেন মহিষমর্দিনী মহামায়া। দেবতাদের কাছে শুম্ভ-নিশুম্ভের অত্যাচারের কথা শুনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন দেবী। তাঁর ক্রোধের তেজে তাঁরই দেহকোষ থেকে নির্গত হলেন কৃষ্ণকায়া দেবী কালিকার এক রূপ, কৌশিকী। আবির্ভুত হয়েই দেবী কৌশিকী রণসজ্জায় সজ্জিত হলেন। তারপর বজ্রনির্ঘোষে যুদ্ধযাত্রা করলেন শুম্ভ-নিশুম্ভের বিরুদ্ধে। দেবী একাই প্রবলা, একাই অসীম ক্ষমতাশালিনী। তিনি ভীষণ যুদ্ধে একে একে চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করলেন। তারপর এলো রক্তবীজ, যার রক্ত মাটিতে পড়লেই তা থেকে শতসহস্র অসুরের জন্ম হয়। নিজের দেহ থেকে চামুণ্ডাকে সৃষ্টি করে রক্তবীজের রক্ত পান করিয়ে তাকে হত্যা করলেন কৌশিকী। তারপর শুম্ভ-নিশুম্ভকে হত্যা করে তিনি ত্রিলোক উদ্ধার করলেন অসুরের অধীনতা থেকে। দেবতাদের ফিরিয়ে দিলেন স্বর্গরাজ্য। তখন দেবতারা এই পরমশক্তিময়ী দেবীর চরণ-বন্দনা করলেন, তাঁর আবির্ভাবকালের অমাবস্যাটির নাম দিলেন, 'কৌশিকী অমাবস্যা'।
দেবী কৌশিকী যেহেতু অত্যাচার, বিপত্তি ও বঞ্চনার হাত থেকে ত্রিলোক রক্ষা করেছিলেন, তাই পৌরাণিক সেই মঙ্গল-আখ্যানের কথা মাথায় রেখে মানুষ আজও এই তিথিতে দেবী কালিকার উপাসনা করেন এবং বিভিন্ন শাক্তপীঠে পুজো দিয়ে সাংসারিক মঙ্গল ও সিদ্ধি কামনা করেন।