জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির ব্যাংকান্দি গ্রাম। গ্রামের মানুষরা সহজ-সরল। চাষবাস মূলত জীবিকা ওই অঞ্চলের মানুষদের। ওখানে রয়েছে অনেক দেবতার থান। এইসব দেবতার থান ঘিরে ওদের ব্যক্তিগত লোকবিশ্বাস কাজ করে। এক একটা থান ঘিরে রয়েছে নানা গল্প। কিছু সত্যি, কিছু অলৌকিক এবং কিছু অতিলৌকিক।
এই ব্যাংকান্দি গ্রামের ভেতর রয়েছে একটা রাস্তা। পাকা রাস্তার পরে একটা কাঁচা রাস্তা। আর এই রাস্তার এক পাশেই রয়েছে ধানক্ষেত। অন্য পাশে সারি সারি কাঁচা মাটির বাড়ি বাঁশের চ্যাগার দিয়ে ঘেরা। একটা বাড়ির পাশে রয়েছে স্তূপ করা শুকিয়ে যাওয়া ভুট্টা। সেটা ছেড়ে এগিয়ে গেলে রয়েছে সবুজের জঙ্গল। দুপাশে পাতাবাহার গাছের সমাহার। আরও একটু এগোলে বাঁশের চ্যাগার দিয়ে রাস্তা আটকানো। সামনে চওড়া নালা। গাছের ডাল পেরিয়ে তারপর মাটির ঢাল। এই মাটির ঢাল পেরলে রয়েছে চায়ের বাগান। চা ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা ধরে এগোলে রয়েছে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের মধ্যেই একটা অদ্ভুত ভিত তৈরি করা হয়েছিল অনেক বছর আগে। যার চারকোণে চারটি খুঁটি, মাথায় টিনের চালা। ওটা আসলে এক লৌকিক দেবতার থান। এই লৌকিক দেবতা হলেন কাঠুয়া ঠাকুর। ধানের ভালো ফলন হওয়ার আশায় এই অঞ্চলের মানুষরা নাকি এই লৌকিক দেবতার পুজো শুরু করেন।
উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গায় ঠাকুরের প্রতীকী মূর্তির বদলে নিশান পুজো করার রীতি এখনো প্রচলিত রয়েছে। এই কাঠুয়া ঠাকুরের ভিতটি সেভাবেই নিশান হিসেবে প্রচলিত। ঘট স্থাপন করেই শুরু থেকে পুজো করা হতো। যেখানে কাঠুয়া ঠাকুরের থান রয়েছে সেই অঞ্চলটা দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। ক্ষেতের চারপাশে ছোট ছোট টিনের চালা করে লৌকিক দেবতার থান তৈরি করা। সেখানে বসানো রয়েছে ঘট। কোথাও আবার পাথর কেটে চৌবাচ্চা তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস এই প্রত্যেকটাই কাঠুয়া ঠাকুরের অস্তিত্বের প্রমাণ। আসলে কৃষিকাজ করতে গেলে জল প্রয়োজন হয়। তাই চৌবাচ্চাকে প্রতীকী ঈশ্বর হিসেবে কল্পনা করা হয়। কৃষিদেবতা হিসেবেই কাঠুয়া ঠাকুরকে কল্পনা করা হয়। এই অংশটিতে একটি মাত্র থানেই একটি দেবতার মূর্তি রয়েছে। সেই দেবতার মূর্তির চারটে হাত। বাহন কচ্ছপ। কচ্ছপের ওপর দেবতা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রাজবংশী ভাষায় কচ্ছপকে বলে কাঠুয়া। সেই থেকেই নাকি নাম হয়েছে কাঠুয়া ঠাকুর।
জনশ্রুতি এখানে যে কয়েকটি থান রয়েছে প্রত্যেকটি নাকি কাঠুয়া ঠাকুরের। তবে যে থানগুলো ধানক্ষেতের অন্য প্রান্তে রয়েছে সেগুলি অন্যান্য লৌকিক দেবতার থান হিসেবে কল্পনা করা হয়।
এই থানের কাছে বহুকাল আগে নাকি একটা বিশাল বটগাছ ছিল। এখন আর গাছটার অস্তিত্ব নেই। এই এলাকার স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার পর কাঠুয়া ঠাকুরের পুজো করেন। এই কাটোয়া ঠাকুর এভাবেই কৃষি দেবতা হয়ে উঠেছেন। যে মূর্তিটিকে কাঠুয়া ঠাকুরের মূর্তি হিসেবে কল্পনা করা হয় বর্তমানে সেই মূর্তিটা অনেকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত। কাঠামোটি বোঝা যায়। অনেকে বলেন প্রত্যেক বছর পুজোর সময় নতুন মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তা আর শেষ হয় না। তখন ঘটকেই পুজো করা হয়। এই পুজোয় উপকরণ হিসেবে লাগে চিড়ে, দই, খই এবং ফলমূল। পুজোর পর ভক্তদের দই চিঁড়েমাখা প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়। ঠাকুরের উদ্দেশে লাগানো হয় লাল নিশান। আগে কাঠুয়া ঠাকুরের পুজো করতেন হরি বৈরাগী। তবে বর্তমান পূজারী পঞ্চানন অধিকারী। এভাবেই ময়নাগুড়িতে লৌকিক কৃষি দেবতা হিসেবে পূজিত হন কাঠুয়া ঠাকুর।