কাত্যায়নী ব্রতঃ কার্তিক মাসে এই ব্রত করে শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পেয়েছিলেন ব্রজবালারা

ভাগবতে বলা হয়েছে যে, হেমন্তের সূচনায় অর্থাৎ কার্তিক মাস জুড়ে কাত্যায়নী ব্রত করে ব্রজগোপিনীরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই দেবী কাত্যায়নী?

দেবী দুর্গার যে ন’টি রূপের কথা আমরা জানি, যাঁদের একত্রে ‘নবদুর্গা’ বলে অভিহিত করা হয়; তারই একটির নাম, ‘কাত্যায়নী’। দেবীর চারটি হাত। দুই ডান হাতে তিনি যথাক্রমে বর ও অভয় দান করেন; আর তাঁর দুই বাম হাতে থাকে যথাক্রমে খড়্গ ও পদ্ম। দেবীর গায়ের রঙ সোনার মতো উজ্জ্বল। সিংহ তাঁর বাহন। ইনি বৈদিক দেবী। ‘কৃষ্ণযজুর্বেদ’-এর ‘তৈত্তিরীয় আরণ্যক’ অংশে এই দেবীর উল্লেখ রয়েছে। ‘হরিবংশ’ গ্রন্থে দেবীর রূপ বর্ণনায় আঠেরোটি হাতের কথা বলা হয়েছে। এই রূপে দেবীর একটি মূর্তি কাশীধামের বীরেশ্বর শিবমন্দিরে বহু প্রাচীনকাল থেকে আজও পূজিত হন। এছাড়াও ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’, ‘দেবীভাগবত পুরাণ’ প্রভৃতি পুরাণে দেবীকে দুর্গার সঙ্গে একাত্ম করে দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তিনি দশভুজা। শাস্ত্রে নবরাত্রি উৎসবের ষষ্ঠ দিনে কাত্যায়নীর পূজার বিধান রয়েছে।

দেবী কাত্যায়নীর আবির্ভাব বিষয়ে নানান কিংবদন্তী ও পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। কাত্যবংশে জন্ম নিয়েছিলেন ঋষি কাত্যায়ন। এই ঋষির নাম ‘মার্কণ্ডেয়’ ও ‘দেবীভাগবত’ পুরাণে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। তিনি একবার দেবী পার্বতীকে কন্যারূপে পাবার জন্য কঠোর তপস্যা করেন। তাতে দেবী তুষ্ট হন। সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বরদান করেন। বলেন যে, ‘হে ঋষি, পিতা যেভাবে কন্যাকে পায়, বিবাহিতা কন্যাকে যেভাবে অল্পদিনের বাৎসল্য দানের অধিকার তিনি পান, সেভাবেই একদিন আমি তোমার কুটিরে পদার্পণ করবো। আবার তুমি যেহেতু আমার পরমভক্ত, সেহেতু তোমার হাতে পুজো পেয়েও আমি ধন্য হবো।’ এভাবেই পক্ষান্তরে, দেবী ভক্ত ও পিতা—ঋষি কাত্যায়নের এই দুটি সত্তার সেবা গ্রহণ করে তাঁকে ধন্য হবার সুযোগ দিলেন।

দেবীর এই বরদানের কিছুকাল পর মহিষাসুরের অত্যাচারে ত্রিলোক যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল, তখন তাকে বধের জন্য দেবতারা দেবীকে আবাহন করলেন। দেবতাদের সম্মিলিত শক্তিতে দেবী আবির্ভূত হয়ে তাঁদের দান করা অস্ত্রে সুসজ্জিত হলেন। তারপর মহিষাসুরকে বধের পূর্বে তিনি ঋষি কাত্যায়নের কুটিরে পদার্পণ করলেন। দেবী কথা রাখলেন। কাত্যায়নও তাঁকে কন্যার স্নেহ দিলেন, সেবকের সেবা দিলেন। এই দুই সত্তার একত্র সম্মিলন বড় কঠিন। তবু নিষ্ঠা দিয়ে ঋষি কাত্যায়ন তা সম্পন্ন করলেন। দেবী একইসঙ্গে তাঁর কন্যা হয়ে ও পূজা পেয়ে ত্রিলোকে ‘কাত্যায়নী’ নামে অভিহিত হলেন। কাত্যায়নের কুটিরে তিনদিন অবস্থান করে অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে দেবী রণভূমে যাত্রা করলেন। তারপর মহিষাসুরকে বধ করে ত্রিলোকের মুক্তিদায়িনী হয়ে পরমপূজনীয়া হয়ে রইলেন।

এখন আসুন দেখি, ব্রজবাসীনী গোপিকারা শ্রীকৃষ্ণকে পতিহিসেবে পাবার জন্য কেন দেবী কাত্যায়নীর ব্রত করলেন, কীভাবেই বা করলেনঃ

পতিলাভের জন্য শিবের ব্রত ও পূজা করার কথা আমরা সবাই জানি। পৌরাণিককাল থেকেই এই প্রথা চলে আসছে। এর পৌরাণিক ও সামাজিক ইতিহাস আছে। এর পাশাপাশি কিন্তু মনের মতো পতি পাবার জন্য দেবী দুর্গার পূজা ও ব্রতের ঐতিহ্যও সেকালে প্রচলিত ছিল। আমরা জানি যে, উমা-পার্বতী আপন পছন্দের কিন্তু পিতা-মাতার অপছন্দের মহাদেবকে পতিহিসেবে পাবার জন্য কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনাময় দীর্ঘ তপস্যা করেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত মহাদেবকে সেই তপস্যার বিনিময়ে লাভ করে তবেই নিরস্ত হয়েছিলেন। পৌরাণিক এই ঘটনার কথা মাথায় রেখেই একদা দেবী দুর্গা পতিলাভেইচ্ছুক কন্যাদের আরাধ্যা হয়ে উঠেছিলেন।

এখানে প্রশ্ন ওঠে, দুর্গাই যদি আরাধ্যা হন, তাহলের ব্রজের কন্যারা তাঁদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সরাসরি দেবী দুর্গার আরাধনা বা ব্রত না-করে দেবীর ষষ্ঠরূপ কাত্যায়নীর ব্রত করলেন কেন?

আসলে, ব্রজভূমির সঙ্গে দেবী কাত্যায়নীর ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। সেই যোগ খুঁজে পেতে আমাদের আরও অতীতের পুরাণকথায় প্রবেশ করতে হবেঃ

মহাদেবের প্রথম পত্নী দেবী সতী। সতীর পিতা প্রজাপতি দক্ষ। একবার এক যজ্ঞে শিব তাঁর এই শ্বশুরকে দেখেও উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাননি বলে দক্ষ খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। প্রতিশোধ নিতে নিজে এক যজ্ঞের আয়োজন করে শিবকে নিমন্ত্রণ করলেন না। পিতাকর্তৃক পতির এই অপমান সতী সহ্য করলেন না। তিনি পিতার যজ্ঞস্থলে গিয়ে অভিমানে প্রাণ ত্যাগ করলেন। শিব এ-সংবাদ পেয়ে অনুচর দিয়ে যজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে প্রবল শোকে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলেন। এই নাচে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যায়। সৃষ্টি রক্ষার জন্য নাচ থামানো প্রয়োজন। আর তার জন্য শিবের দেহ থেকে সতীকে আলাদা করতে হবে। সে-কারণেই শেষ পর্যন্ত পরমপিতা ব্রহ্মার নির্দেশে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ একান্নটি টুকরো করে শিবের দেহ থেকে সতীকে বিচ্যুত করলেন। তখন শিব থামলেন। সৃষ্টি বাঁচল। আর সতীদেহের একান্নটি টুকরো পৃথিবীর যেখানে যেখানে পতিত হল, সেখানে সেখানে একটি করে সতীপীঠ গড়ে উঠল। কৃষ্ণধাম বৃন্দাবনেও দেবী সতীর দেহাংশ পতিত হয়েছিল। এখানে পতিত হয়েছিল তাঁর মাথার কেশরাশি। দেবীর কেশরাশি প্রস্তরীভূত হয়ে আজও এখানে স্বমহিমায় পূজিতা হন। এবং এখানে তাঁর দেবীরূপের নাম, ‘কাত্যায়নী’। শ্রীকৃষ্ণ ও গোপসম্প্রদায়ের গোকুল থেকে বৃন্দাবনে এসে বসতি তৈরির আগে থেকেই দেবী কাত্যায়নী এখানে বিরাজিত ছিলেন এবং পূজিতা হতেন। সকলেই জানতেন যে, দেবী দুর্গা ও কাত্যায়নীর মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। কেননা, দু’জনেরই মূল আধার দেবী আদ্যাশক্তি। এবার যেখানে যে-দেবী প্রসিদ্ধা, সেখানকার কন্যারা সেইরূপেই দেবীর উপাসনা ও ব্রত করবেন—এটাই তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার পথ ধরেই ব্রজবালারা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পেতে দেবী কাত্যায়নীর ব্রত করেছিলেন।

কীভাবে তাঁরা এই ব্রত করেছিলেন, তার সুন্দর বিবরণ আছে ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ রচিত ‘লীলাপুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে। তার অংশ-বিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছিঃ

‘অবিবাহিতা গোপিকারা কাত্যায়নী দেবীর প্রতিমা নির্মাণ ক’রে, তাতে চন্দন লেপন ক’রে, মাল্য অর্পণ ক’রে, ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে, এবং সবরকমের উপাচার সহকারে—ফল, ফুল, পল্লব আদি দিয়ে তাঁর পূজা করতেন। পূজা করার পর কোন বর প্রার্থনা করাটাই হচ্ছে রীতি। অবিবাহিতা বালিকারা গভীর আবেগের সঙ্গে কাত্যায়নী দেবীর কাছে প্রার্থনা করতেন, “হে পরমেশ্বর ভগবানের পরাশক্তি, হে যোগমায়া, হে জড়জগতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কৃপা ক’রে আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন যেন নন্দ মহারাজের পুত্র কৃষ্ণের সঙ্গে আমার বিবাহ হয়।”...তাঁরা পুরো একমাস ধরে দুর্গাদেবীর (কাত্যায়নী) পূজা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার জন্য। প্রতিদিন তাঁরা প্রার্থনা করেছিলেন, নন্দ মহারাজের পুত্র কৃষ্ণের সঙ্গে যেন তাদের বিবাহ হয়।’

স্নান করে শুদ্ধ মনে কৃত গোপবালাদের এই ঐকান্তিক ব্রতে দেবী কাত্যায়নী অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলেন। তিনি এই কন্যাদের ইচ্ছেপূরণে সহায় হয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই তো অপার লীলাময়; তিনি এক অনন্য লীলার মাধ্যমে দেবীর অভিপ্রায় ও কন্যাদের ইচ্ছে যুগপৎ পূর্ণ করেছিলেন। আয়োজন করেছিলেন বস্ত্রহরণ লীলার।

সেকালের নিয়ম অনুযায়ী যমুনায় কন্যাদের জন্য আলাদা একটি আবডালযুক্ত ঘাট ছিল। সেখানে পুরুষেরা যেতেন না। ঘাটের উপর বস্ত্র খুলে রেখে তাই নির্দ্বিধায় গোপকন্যারা যমুনার জলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে স্নান করতেন। কার্তিকের শেষ, ব্রত সমাপন হয়েছে; এমন সময় এই ঘাটে একদিন তাঁরা নগ্ন হয়ে স্নান করতে নেমেছেন। স্নানে নেমে তাঁরা কৃষ্ণের অতুল রূপের কথা বলছেন, তাঁকে ঘিরে আপন আপন কামনার কথা বলছেন। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ চুপি চুপি এসে তাঁদের সমস্ত বস্ত্র চুরি করে ঘাটের নিকটের একটি গাছের উপর উঠে বসলেন। গোপকন্যারা জলক্রীড়ার শেষে যখন খেয়াল করলেন যে, তাঁদের বস্ত্র যথাস্থানে নেই; তখন তাঁদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল এই অবস্থায় কীভাবে বাড়ি ফিরবেন সে-কথা ভেবে! এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ আপন উপস্থিতির কথা জানালেন। এও জানালেন যে, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় একে একে জল থেকে উঠে এসে গোপিনীদের তাঁর কাছ থকে বস্ত্র নিয়ে যেতে হবে, নতুবা তিনি বস্ত্র দেবেন না। গোপকন্যারা অনেক অনুনয় করলেন, নন্দ মহারাজকে নালিশ করার ভয় দেখালেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। শেষমেশ তাঁরা বাধ্য হলেন একে একে নগ্ন অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে এসে আপন আপন বস্ত্র নিয়ে যেতে। এখন কথা হচ্ছে, এই লীলা শ্রীকৃষ্ণ কেন করলেন? এতে দেবী কাত্যায়নীর অভিপ্রায় কীভাবে পূর্ণ হল?

দেখুন, স্বাভাবিক নিয়মে স্ত্রী কেবল নগ্ন হয়ে স্বামীর কাছে যান, অন্য কারও কাছে নয়। তাই এই লীলার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের ওপর স্বামীস্ত্রী সম্পর্কের আচার পালন করে গোপকন্যাদের পত্নীত্বে বরণ করে তাঁদের ইচ্ছেপূরণ করলেন। এই লীলাকে প্রাকৃতজীবনের সঙ্গে মেলালে চলবে না, মেলালেই অশ্লীল মনে হবে। এগুলো প্রতীকী ঘটনা হিসেবে দেখাই শ্রেয়। তাই এইসব ঘটনাসমূহকে ‘লীলা’ বলা হয়।

যাই হোক, এতক্ষণ ধরে এটা বোঝা গেল যে, দেবী কাত্যায়নী কে, কেন তাঁর ব্রত করা হয়, কীভাবে তাঁর ব্রত করা যায়। শেষে তবু একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, দেবী দুর্গা বা কাত্যায়নী তো শাক্তদের দেবী। আমরা জানি যে, বৈষ্ণব কৃষ্ণভক্তরা তাঁদের পুজো করেন না। তাহলে কৃষ্ণভক্ত হয়ে গোপিনীরা দেবী কাত্যায়নীর ব্রত করলেন কেন?

আসলে শাক্ত ও বৈষ্ণবের এই বিরোধ খুব বেশি প্রাচীন নয়। এই বিরোধ পরবর্তী সাম্প্রদায়িক বিভেদবুদ্ধির ফল। স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণের জীবনে এই ভেদাভেদ একেবারেই ছিল না। দ্বারকায় তাঁর দুর্গাপূজার কথা জানা যায়। জন্ম সময়ে শ্রীকৃষ্ণের জীবনরক্ষায় পরিবর্ত হিসেবে পিতা বসুদেব যে কন্যাসন্তানকে তুলে এনেছিলেন, তিনি তো আদ্যাশক্তির অংশ, দেবী মহামায়া। কৃষ্ণলীলায় তাঁর অসামান্য যোগদান রয়েছে। ‘ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ’-এর কাহিনীতে আমরা দেখতে পাই যে, শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের ডাকে যখন কুঞ্জবনে এসেছেন। তখন আয়ান ও তাঁর মা রাধার পিছু নিয়ে দেখতে পান যে, শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রেম করছেন না, কৃষ্ণকালীর পুজো করছেন। আধখানা কৃষ্ণ, আধখানা কালী। কৃষ্ণ কালো, কালীও কালো। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ প্রমাণ করে গেছেন যে, কৃষ্ণ ও কালীতে কোন প্রভেদ নেই, কোন বিরোধ নেই, দু’জনেই একই সত্তার ভিন্ন রূপ। ভিন্ন উদ্দেশ্যে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দু’জনের আবির্ভাব। আসলে, ঈশ্বরে ঈশ্বরে প্রকৃতপক্ষে কোন বিরোধ নেই। ফলত, গোপিনীরা শ্রীকৃষ্ণের এই শিক্ষাই অনুসরণ করেছেন। তাই কৃষ্ণভক্ত হয়েও শাক্ত দেবী কাত্যায়নীর আরাধনা করতে তাঁদের এতটুকুও বাধেনি।।...           

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...