ছোট্ট শিশি। ভিতরে হলুদ রঙের পদার্থ। একটু চটচটে। হাতে লাগলে অনেক ক্ষণ গন্ধ লেগে থাকে। আশি-নব্বইয়ের মধ্যবিত্ত বাড়িতে ওষুধের বাক্সে দেখা মিলত এই মহৌষধীর। যে কোনও ব্যথার সুরাহা। মাথা ধরলেই খোঁজ পড়ত তার। অম্রুতাঞ্জন। চলতি কথায় অমৃতাঞ্জন। দুয়ের মধ্যে তফাৎ নেই কোনও।
মারাঠি অম্রুতাঞ্জন বদলে বদলে যায় প্রাদেশিক উচ্চারণে, কিন্তু বদলায় না তার কাজ। কীভাবে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল অম্রুতাঞ্জন?
সে কাহিনিও ব্যথা সেরে যাওয়ার মতোই কম আকর্ষণীয় নয়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে এই দাওয়াইয়ের অব্যর্থ যোগ। কারণ এই মহৌষধী এক বিপ্লবীর স্বপ্নের ফসল। তাঁর নাম কাসিনাথুনি নাগেশ্বর রাও। নাগেশ্বর রাও পন্টুলু নামেও তিনি পরিচিত।
একাধারে সাংবাদিক, সমাজকর্মী নাগেশ্বর রাও গাঁধীজির সঙ্গে সত্যাগ্রহ আন্দোলন, খদ্দর আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে অন্ধ্রপ্রদেশকে পৃথক রাজ্য গড়ে তোলার আন্দোলনেও অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল।
১৮৬৭তে অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা জেলায় তাঁর জন্ম হয়। অন্ধ্রপ্রদেশে নিজের ভূমিতেই স্কুলস্তরের পড়াশোনা শেষ করে মাদ্রাজ খ্রিষ্টান কলেজে ভর্তি হন। সেই পর্ব শেষ হলে ফার্মাসিস্ট সংস্থায় কাজ করতে চলে আসেন কলকাতায়। খুব সামনে থেকে জানতে লাগলেন ওষুধ ব্যবসার আনাচকানাচ। এ ছিল তাঁর প্রশিক্ষণ পর্ব। ক্রমশ মেডিসিন নিয়েও গড়ে উঠতে লাগল ধারণা। এই কাজ করতে তাঁর খারাপ লাগত না মোটেই। জানার আগ্রহও ছিল ভীষণ। সেই খিদেই তাঁকে সাফল্য এনে দিল। নাগেশ্বর যোগ দিলেন বিদেশি সংস্থা উইলিয়াম অ্যান্ড কোম্পানিতে। কলকাতা ছেড়ে পাড়ি দিলেন বোম্বাই।
কেরিয়ারের গ্রাফ উপরে উঠলেও কিছুতেই যেন কাঙ্খিত তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল নিজের জন্য নিজের কিছু করার কথা। দেশপ্রেমের ভাবনাও কাজ করেছিল কোথাও। তেলেগু রেনেসাঁসের জনক কান্দাকুরু ভিরিসালিঙ্গম পান্তুলুর অনুগামী ছিলেন তাই বিদেশি প্রভুর চাকরিতে থাকতে আর মন সায় দিচ্ছিল না একেবারেই।
কলকাতা ও বোম্বাইয়ে কাজ করতে গিয়ে যা যা শিখেছিলেন সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই মন দিলেন অন্য ভাবনায়। আয়ুর্বেদ বিদ্যায় জ্ঞান ছিল তাঁর। রীতিমতো আয়ুর্বেদ বিদ্যা চর্চা করতেন। দুই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তৈরী করলেন এক বিশেষ ফর্মুলা। তা থেকেই জন্ম হল সেই হলুদ রঙের ব্যথাহরা বামের। নাম দিলেন অম্রুতাঞ্জন।
১৮৯৩-তে বোম্বাই শুরু করলেন বড় মাপে উৎপাদন। শুরুর দিকের লড়াই খুব কঠিন ছিল। প্রচার কৌশল ও বিপণনে অভিনবত্ব আনলেন। বিভিন্ন সঙ্গীত অনুষ্ঠানে যেখানে প্রচুর মানুষের জমায়েত সেই সমস্ত জায়গায় উপস্থিত জনতার মধ্যে বিনামূল্যে অম্রুতাঞ্জন বিলি করতে শুরু করলেন। কাজ দিল তাঁর এই প্রচারকৌশল।
‘ফ্রি গিফট’র কার্যকারিতে দেখে মানুষ দোকানপাটে খুঁজতে লাগল সেই হলুদ রঙের ছোট্ট শিশি। চাহিদা বাড়ল বাজারে। নাগেশ্বর রাওকে আর ফিরে তাকাতে হল না।
একেবারে শুরুতে অমরুতাঞ্জনের দাম ছিল দশ আনা। চাহিদা বাড়লেও মূল্য সবসময় সব স্তরের মানুষের কথা ভেবেই স্থির রাখতেন তিনি। এই পথেই লক্ষ্মী ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে।
তাঁর কর্মজীবনের সাফল্যকে কখনও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিধিতে বেঁধে রাখতে চাননি। চেয়েছিলেন এমন কিছু করতে যাতে বহু মানুষ উপকৃত হয়। তাই আর্থিক দিক থেকে ব্যবসা নিজের পায়ে দাঁড়াতেই নিজের ভূমির প্রতি দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হন। বিশ্বাস করতেন তেলেগুভাষী মানুষদের জন্য চাই নিজের ভূমি। বোম্বাইতে তেলেগুভাষী মানুষদের এক করার কাজে উদ্যোগী হন। প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক অন্ধ্র পত্রিকা। পাঁচ বছরের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পত্রিকা। ১৯৩৬-এ মাদ্রাজ অধুনা চেন্নাই চলে াসার সিদ্ধান্ত নেন। সাপ্তাহিক অন্ধ্রপত্রিকা দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হতে শুরু করে।
নাগেশ্বর রাও হয়ে ওঠেন অন্ধ্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ। ১৯২৪-৩৪ টানা দশ বছর অন্ধ্র রাজ্য কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালের ১৯ ডিসেম্বর নাগেশ্বর রাওয়ের দ্বিতীয় স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু সেই দিনটি অদেখাই থেকে যায় তাঁর।
১৯৩৭ সালে মুম্বইয়ে তাঁর বাড়িতেই তেলুগু নেতারা বৈঠক করেন এবং পৃথক রাজ্য নিয়ে যাবতীয় পরিকল্পনা করেন। তাঁর সক্রিয় ভূমিকার জন্য তিনি ‘দেশোদ্ধারাকা’ নামে পরিচিত হন।
১৯৩৮-এর ১১ এপ্রিল প্রয়াত হন অমরুতাঞ্জনের আবিষ্কারক। অন্ধ্র গ্রন্ধ মালা নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা এবং গ্রন্থাগারও স্থাপন করেছিলেন তিনি। জীবনের কোনও স্বপ্ন অধরা রাখতে নেই। এই ছিল তাঁর জীবনবোধ, সেই স্বপ্ন সফল করার পূর্ণ সময় যদি নিজের নাও থাকে তাহলে যেন তার বীজ ছড়িয়ে যায় উত্তরসূরির স্বপ্নে- এ শুধু কথার কথা নয়, এই ভাবনা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অনুরাগীদের মধ্যেও।
ব্যথার দাওয়াই ছাড়াও বর্তমানে অন্যান্য ঔষধ পণ্যে আছে সংস্থার। ২০০৭ সালে অম্রুতাঞ্জন লিমিটেড থেকে নাম বদলে হয় অম্রুতাঞ্জন হেলথ কেয়ার লিমিটেড।
তথ্য সূত্রঃ ইকোনমিক্স টাইমস
বেটার ইন্ডিয়া
ওয়ার্লড অফ অম্রুতাঞ্জন