শীতের অতিথিঃ কাশ্মীরি শালওয়ালা

শীতের মহানগরে ওরাও এক অতিথি। এত বছর ধরে এই আসা যাওয়ার পরম্পরা, অতিথি না বলে হাফ নাগরিকও বলা যায়। চাইলে ওরা অনায়াসেই কোনও না কোনও ওয়ার্ডের ভোটার হয়ে উঠতে পারতেন।

কাশ্মীরের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্কটা অনেক পুরনো। ভ্রমণ প্রিয় বাঙালিরা যেমন ভূস্বর্গে বেড়াতে যান, তেমনি ওরাও আসেন সুদূর কাশ্মীর থেকে কলকাতায়। কেউ কেউ থেকে যান কলকাতার অলিতে গলিতে। আবার কেউ কেউ ছড়িয়ে পড়েন উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জেলায় জেলায়। শীত এলেই দেখা মিলত সেই কাশ্মীরি শালওয়ালাদের।

বছরের পর বছর এভাবেই ওদের আনাগোনা। আমরাও চিনে ফেলতাম আলতাপ চাচা, সেলিম ভাই, আফরোজ মিয়াঁকে। আবার ওরাও চিনে ফেলতেন মুখার্জী কাকিমা, চৌধুরি বৌদি বা ছোট্ট পাপড়িকে। ধর্ম, প্রদেশ, ভাষা সব ব্যবধান ঘুচিয়ে গড়ে উঠত অন্য এক আত্মীয়তা। কারও কারও বিয়ে বাড়ি, অন্নপ্রাশনেও দিব্যি ওদের নেমন্তন্ন থাকত।

যেমন আলতাপ মিয়াঁর কথাই ধরা যাক। কলকাতায় আসছেন ১৯৯০ থেকে। প্রথমবার এসেছিলেন চাচার সহকারি হসেবে। প্রথমবারই দেখে নিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, নিউমার্কেট। পরের বছর ফের হাজির। সেবার ঘুরলেন কফি হাউস, হাতিবাগান, উত্তর কলকাতার অলিগলি। একটু একটু করে ধরা দিল কলকাতার স্পন্দন। অসুস্থতার জন্য একসময় চাচার আসা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু রুটিনে ছেদ পড়েনি আলতাপ মিয়াঁর। শহরে এসে যেতেন পুজোর আগেই।

কিছু শাল সঙ্গে নিয়ে, কিছু শাল ট্রান্সপোর্টে অগ্রিম বুকিং করে। উঠতেন রিপন স্ট্রিটের এক চেনা ঠিকানায়। পুজোর আগে থেকেই বিভিন্ন দোকন ঘুরে ঘুরে অর্ডার নেওয়ার কাজ শুরু। যেরকম অর্ডার এল, ফোনে সেই অনুযায়ী অর্ডার দিয়ে দিলেন শ্রীনগরে। সময় মতো ট্রান্সপোর্টে ঠিক মাল পৌঁছে যাবে।

সব দোকান যে এক সঙ্গে বায়না করে তেমন নয়। কেউ বায়না করে পুজোর আগেই, কেউ বা কালীপুজোর পর। দোকানীরা ডেলিভারিও নেন দফায় দফায়। এর পর পাড়ায় পাড়ায় চলে ফেরি। চেনা ঘর, চেনা খদ্দের তো আছেই। এই চেনার পরিধিটা বাড়তে থাকে বছর বছর। শুধু শাল নয়, সব কিছুই রাখতে হয়। কেউ ডাকে শাল কাকু, কেউ বলে শাল ভাইয়া-এগুলোও তার একেকটা আদরের নাম। প্রথম প্রথম রাগ হত। পরের দিকে মনে হল এটাও তো মিষ্টি সম্বোধন। শুনতেও তো মন্দ লাগছে না। এরই মাঝে এক বন্ধুর পরামর্শে একদিন নন্দনে দেখে এলেন ‘কাবুলিওয়ালা’। ততদিনে একটু একটু বাংলা শিখে গেছেন। দু’চোখ ভরে দেখলেন মিনি আর  রহমতকে। দু চোখ বেয়ে বৃষ্টি নেমে এল।

বছরখানেক পর কলকাতায় নিয়ে এলেন সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ইয়াসমিনকে।  সেও এক দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেল এই শহরটার। কিন্তু তাকে নিয়ে তো দোকানে দোকানে বা পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করা যায় না। একটা উপায় বের করলেন আলতাপ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শাল বিক্রি। বিকেল সন্ধে শুধুই ইয়াসমিনের। বাড়িতে ততদিনে টিভি এনে ফেলেছেন। একদিন হঠাৎ করে দেখলেন ‘কাবুলিওয়ালা’ চলছে টিভিতে। ইয়াসমিনকেও জোর করে দেখালেন। বেচারি ইয়াসমিন! তখনও বাংলা কিছুই বুঝত না। কিন্তু এ ছবি এমনই এক ছবি যা সব ভাষার প্রাচীরকে ভেঙ্গে দিতে পারে। সেদিনই ঠিক হয়ে গেল তাদের মেয়ে হলে নাম হবে মিনি।

ইয়াসমিন ফিরে গেল। বছর দুই পর তাদের মেয়েও হল। যথারীতি নাম হল মিনি। মিনিকেও কলকাতায় নিয়ে এসেছেন আলতাপ। ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন সবকিছু। ততদিনে তৈরি হয়ে গেছে সায়েন্সসিটি, নিকোপার্ক। আলতাপের কাজের ধরণও সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে অনেকটাই। বাজারে হাজির অনলাইন শপিং-এর মহাদৈত্য। যারা গিলে খেতে চায় আলতাপদের মতো ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের। উপায় ছিল দুটো।

এক, তাদের সঙ্গে লড়াই করা। দুই, তাদের ব্যাবসার সঙ্গে নিজের ব্যবসাকেও একটু মিলিয়ে দেওয়া। প্রথম লড়াইয়ের মতো পুঁজি ছিল না। ফলে আলতাপ বেছে নিলেন দ্বিতীয়টাই। ছোট বড় দোকানের পাশাপাশি তার ক্লায়েন্ট এখন শপিং মল এবং অনলাইন ডেলিভারি সার্ভিস। তারাই এখন আলতাপের কাছে মাল কেনে সুদৃশ্য প্যাকেটে মুড়ে। পৌঁছে দেয় ঘরে ঘরে। কাশ্মীরি শালের জায়গায় এসে যাচ্ছে লুধিয়ানার মেশিনে তৈরী শীতবস্ত্রও। চোখের সামনে এই বদলে যাওয়া সময়টাকে দেখলেন আলতাপ।

এত বছরের অভ্যেস। কলকাতায় না এসেও পারেন না। তাই শীত আসার আগে টিকিট কেটে ফেলেন আলতাপ। বদলে গেছে সময়। এসেছে বিপননের নিত্য নতুন কলাকৌশল। তার মাঝেই বেঁচে থাকার নতুন রাস্তা খুঁজে নিতে হয় আলতাপ মিয়াঁদের। এখনও পথ চলতি কোনও ছোট্ট কিশোরীকে দেখলে মনে পড়ে যায় মিনির মুখখানা। হাতের স্মার্ট ফোন থেকে কিছুটা অকারণেই ভিডিও কল করে বসেন শ্রীনগরের মিনিকে। শীতের মিষ্টি রোদে আবার কোথাও মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় কলকাতা-কাশ্মীর।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...