ইতু, ছট যেমন শস্য ও কৃষির লৌকিক দেবী, তেমনি করম হলেন শস্য ও কৃষির লৌকিক দেবতা। তিনি শস্য ও বৃক্ষপ্রতীকে পূজিত হন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অরণ্যঅঞ্চলের কুরমি, মাহাত, কর্মকার ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে। তাঁর পূজা হয় ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে। তবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকেই এই তিথি মানেন, অনেকেই আবার মানেন না। না-মানলে ভাদ্র মাসের যে-কোন দিন এই পুজো করে থাকেন। যেখানে ভাদ্র মাসে ইঁদ পুজো হয়, সেখানে তিথি মেনেই করম পুজো সেরে ফেলা হয়। কেননা, করম পুজো না-হলে ইঁদ পুজো করা যায় না।
ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে কেন করম পুজো হয়; আর করম ঠাকুরের পুজো করলে কী কী ফললাভ ঘটে, সে-কথা জানা যায় করম ঠাকুরের ব্রতকথার গল্প থেকে। গল্পটি পুজোর সময় লায়া অর্থাৎ পুরুত ঠাকুর ব্রতী ও ব্রতচারিণীদের শুনিয়ে থাকেন। সেটি হলঃ
কোন এক গাঁয়ে ধর্মা আর কর্মা নামে দুই ভাই ছিল। তারা ছিল বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ, সম্পন্ন চাষি। প্রতি বছর যখন সুযোগ হত, ধুমধাম করে করম ঠাকুরের পুজো করত। কিন্তু একবার কর্মা করে ফেলল মহাভুল। ব্রতভঙ্গের সময় যেখানে পান্তা খাওয়ার কথা, সেখানে সে খেয়ে ফেলল গরম ভাত।
অমনি ভক্তের ভুলে তাতে ফোস্কা পড়ে করম ঠাকুরের সারা গা জ্বলতে শুরু করল। তিনি তাতে খুব রেগে গেলেন। জ্বলুনি সহ্য করতে না-পেরে অনন্ত সাগরের জলে গা ডুবিয়ে রইলেন। কিন্তু তাতেও তাঁর জ্বলুনি কমল না, রাগও ঠাণ্ডা হল না। ফলে সেই রোষের কোপ পড়ল কর্মার ওপর। তার সুদিন গিয়ে দুর্দিন এল। দুই ভাই ভেন্ন হল। দু’বেলা আহার জোটানো দায় হয়ে দাঁড়াল কর্মার সংসারে। নিজের জমি উচ্ছন্নে গেল, অন্যের জমিতে খেটেও খেতে পেল না। অনাহারে চোখের জলে কোনরকমে তার দিন কাটতে লাগল।
কর্মার এই দুঃখ দেখে আকাশদেবতার দয়া হল। তিনি আকাশবাণীতে বললেন, ওহে কর্মা শোন, ব্রতভঙ্গে গরম ভাত খেয়ে করম দেবতার রোষের কারণ হয়েছ তুমি! অনন্ত সাগরে তিনি রয়েছেন, তাঁর কাছে গিয়ে পূজা-প্রার্থনায় তাঁকে তুষ্ট কর। তাহলেই তোমার অবস্থার পরিবর্তন হবে, নইলে এভাবেই সারাজীবন কাটাতে হবে।
কর্মা নিজের ভুল বুঝতে পেরে এবং মুক্তির পথ দেখতে পেয়ে অন্তরের আকুতি নিয়ে অমনি সেই অনন্ত সাগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মাঠ, ঘাট, গ্রাম, গঞ্জ, নগর, বাজার পেরিয়ে সে হাঁটতেই থাকে, তবু অনন্ত সাগরের কাছে কিছুতেই পৌঁছতে পারে না। পথে কত মানুষ, কত পশু, কত প্রাণির সঙ্গে দেখা হয় তার; সবাইকে সে সত্যি কথা বলে। বলে যে, সে করম ঠাকুরের কাছে যাচ্ছে। অমনি তারা তাঁর কাছ থেকে নিজেদের সমস্যার থেকে মুক্তির উপায় জেনে আসার অনুরোধ জানায়। কর্মা সরলভাবেই কথা দেয় যে, সে জেনে আসবে।
বহুদিন ধরে বহু পথ চলার পর অবশেষে একদিন সে পৌঁছে যায় এক সাগরের তীরে। যতদূর চোখ যায়, শুধু জল আর জল। বুঝতে পারে এই হচ্ছে সেই অনন্ত সাগর, যার কথা আকাশদেবতা বলেছিলেন।
অনন্ত সাগরের তীর ধরে খুঁজতে খুঁজতে এক সময় সে দেখতে পায় করম ঠাকুরকে। গায়ের জ্বালায় তিনি তখন কেবলই সাগরের শিতল জলে ডুবছেন আর উঠছেন। ঠাকুরের এই কষ্ট দেখে কর্মার চোখে জল এসে গেল। সে ছুটে গিয়ে জলে নেমে ঠাকুরের কাছে হাতজোড় করে বার বার ক্ষমা ভিক্ষা করল। চোখের জলে অন্তরের সমস্ত ভক্তি উজাড় করে সেখানেই করমের পূজা শুরু করে দিল। তার অনুশোচনা আর আকুতি মেশানো চোখের জল সাগরে মিশল। সেই জলে করম ঠাকুরের জ্বলুনি গেল, তাঁর শরীর শীতল হল। তিনি কর্মার ভক্তিতে তুষ্ট হলেন। বর দিয়ে বললেন, বৎস কর্মা, যাও ঘরে ফিরে যাও। আর তোমার কোন অভাব থাকবে না, দুঃখ থাকবে না, কষ্টও থাকবে না। প্রতি বছর ভাদ্রের শুক্লা একাদশী তিথিতে আমার পূজা করবে, আর ব্রতভঙ্গে পান্তা খাবে। ভুলেও গরম ভাত খাবে না। কেমন?
কর্মা মাথা নেড়ে পথে যাদের সমস্যার সমাধান জেনে যাবার কথা দিয়েছিল, তাদের সমস্যার সমাধান জেনে করম ঠাকুরকে ভক্তিভরে প্রণাম করে আপন ঘরের দিকে রওনা দিল। পথে একে একে সকলের সঙ্গে দেখা হল, তারা সমস্যার সমাধান জানতে পেরে খুব খুশি হয়ে কর্মাকে প্রচুর ধনদৌলত দিল। সে-সব ছাড়াও হারানো সম্পদ ফিরে পেয়ে কর্মার আর কোন অভাব রইল না, দুঃখ রইল না। করম ঠাকুরের কৃপায় ছেলেমেয়ে বউমাজামাই নাতিপুতি নিয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগল।
আগেই বলেছি যে, করম ঠাকুর বৃক্ষপ্রতীকে পূজিত হন। যে বৃক্ষের প্রতীকে পূজিত হন, সেই বৃক্ষের স্থানীয় নাম, ‘চাকলতা’ বা ‘করম’। করম গাছের বড় বড় পাতা, বর্ষায় ছোট ছোট কদমের মতো ফুল হয়। এই গাছের যে ডালের মাথায় দুটি শাখা থাকে অর্থাৎ যে ডালের আকৃতি ইংরেজি ‘ওয়াই’ অক্ষরের মতো, সেই ডাল বাড়িতে কেটে এনে মাটিতে স্থাপন করে করম ঠাকুরের পুজো করা হয়। কোথাও বা আলাদা আলাদা তিনটে ডাল কেটে এনে পাশাপাশি স্থাপন করেও পুজো করা হয়। বৃক্ষপুজোর মধ্যে যে উদ্দেশ্য থাকে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। শালের মতোই করম গাছের কাঠ পূর্বে অরণ্যবাসী মানুষের গৃহনির্মাণে কাজে লাগত; তাদের প্রিয় অরণ্যভূমিকে সাজিয়ে রাখত। তাই এই গাছগুলি কেউ যাতে অযথা নষ্ট না-করে বিশেষ যত্নে রক্ষা করে, সেই জন্য তাদের পুজোর মধ্য দিয়ে দেবতার আসনে বসানো হয়েছিল। তাই আমরা দেখতে পাই যে, অরণ্যবাসী মানুষ এখনও সরহুল উৎসবে শালগাছের পুজো করেন।
করম ঠাকুরের পুজোয় কোথাও আমরা দেখতে পাই অবিবাহিতা ছেলেমেয়েরাই ব্রতী ও ব্রতিনী হিসেবে অংশ নিতে; আবার কোথাও দেখি ছেলেবুড়ো বউঝি আপামর সকলেই অংশ নিচ্ছেন।
ইতুব্রতের মতোই করমব্রতের ক’দিন আগে থেকেই ব্রতিনীদের শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। তাঁরা মেতে ওঠেন ‘জাওয়া ডালি’ তৈরিতে। সেটা কী? সেটা হচ্ছে, কাঠি দিয়ে বেশকিছু শালপাতা বাটির আকারে সেলাই করে তাতে ভেজা বালি নিয়ে তার ওপর কিছু শস্য বুনে দেওয়ার একটা আচার। একে বলে, ‘জাওয়া পাতা’। এই দিন থেকে প্রতিদিন একবার করে তাঁরা ওই শস্যের বীজের ওপর হলুদ জল ছেটান। নিজেরা তেল ছাড়া স্নান করে এলোচুলে থাকতে শুরু করেন। সকাল-সন্ধ্যে জাওয়া ডালির সামনে প্রদীপ জ্বালান। তারপর জাওয়া ডালিকে ঘিরে সকলে মিলে হাত ধরাধরি করে নাচতে নাচতে গাইতে থাকেন ‘জাওয়া গান’। সে গান কেমন? তাতে থাকে লৌকিকজীবনের নানান অনুষঙ্গ, অন্তঃপুরের মেয়েদের সুখদুঃখের কথা, গেরস্তের অভাব-অভিযোগ আনন্দের কথা, পুরাণের কথা। যেমন, একটি গানে রয়েছে অনেক দূরে বিয়ে হওয়া এক কন্যের বাপের বাড়ির জন্য মনখারাপের কথাঃ
‘করবরী ফুল করবরী ফুল ফুটে লাল লাল গো;
ঝি-ছানার মিছা জনম, কাইন্দছে অন্তর গো।
ঝি-ছানা ঝি-ছানা ধূরে শ্বশুর ঘর গো।’... ইত্যাদি
করমের দিন জাওয়া ডালিতে বপন করা বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারার আকার নেয়। এ-দিনই উঠোনে করম গাছের ডাল এনে স্থাপন করা হয়। তার সামনে রাখা হয় জাওয়া ডালি। উপচার হিসেবে থাকে বেল পাতা, আম পাতা, দুব্বো ঘাস, প্রদীপ, হরতুকি, দাঁতন, চিঁড়ে, আতপ চাল, বাতাসা, চালের গুঁড়ো মাখানো বোঁটাযুক্ত শসা, ধানের চারা এবং ফুল।
ব্রতী ও ব্রতিনীদের নাচগান, পুস্পাঞ্জলি দেওয়া এবং লায়ার ব্রতকথা বলার মধ্য দিয়ে পুজো শেষ হয়। কিন্তু তাতে উৎসব শেষ হয়ে যায় না। উৎসব চলে সারারাত। ব্রতী ও ব্রতিনীরা জাওয়া ডালি সেই রাত কাটিয়ে দেন নাচগানের মধ্য দিয়ে। পরদিন সকালে জাওয়া ডালির অঙ্কুরিত বীজ কেউ ভাসিয়ে দেন, কেউ মাটিতে বুনে দেন এবং পুজোয় ব্যবহৃত ধানের চারা জমিতে ফের লাগিয়ে দিয়ে আসেন। কামনা করেন জমিভরা ফসলের।
পুজোর সময় যে নাচগান চলে, তাতে নাচের ভঙ্গিমায় থাকে ফসল রোপণ, পরিচর্যা এবং কাটার নানান ক্রিয়া। এটা আসলে বর্ষাকালীন ধান চাষ যাতে ভালো হয়, যাতে সেই ধানে চাষির গোলা উপচে পড়ে; তারই কামনায় জাদুক্রিয়ামূলক নাচ। তাই করম কৃষির দেবতা তো বটেনই, কেননা বর্ষাকালীন ধান চাষের কামনা এইভাবে সরাসরি তাঁর সঙ্গে জুড়ে আছে; সেই সঙ্গে তিনি কর্ম ও সৌভাগ্যেরও দেবতা। ব্রতকথার কর্মার গল্প থেকে আমরা সেই উদাহরণই পাচ্ছি। অন্যদিকে দেখতে গেলে কর্ম ও কৃষির সাফল্যেই কিন্তু সৌভাগ্য লুকিয়ে থাকে। অনেকের কাছেই করম ঠাকুর সন্তানদায়ী দেবতা। তাই অনেকেই তাঁর ব্রত করে সন্তান কামনা করেন। ফলে, করম তাঁদের কাছে উর্বরতার দেবতা। সভ্যতার কোন এক বাঁকে উর্বরতা ও প্রজননের প্রতীক হিসেবে লিঙ্গ পূজার সূচনা হয়েছিল। করম পূজায় উপচার হিসেবে ব্যবহৃত চালের গুঁড়ো মাখানো শসাটি, সেই লিঙ্গের প্রতীক।...