পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই কুখ্যাত শেষ বলে ছয় খেয়ে হার ভারতের। কিন্তু ওই ম্যাচের ইনিংস ব্রেকেই ঘটে গিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। ড্রেসিং রুমে উপস্থিত এক অজানা ব্যক্তি। লোভ দেখালেন প্লেয়ারদের। বললেন গাড়ি দেবেন। শুনেই তাকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিলেন অধিনায়ক। যিনি তাড়া খেলেন তিনি 'ডি' কোম্পানির মালিক। আশা করি বোঝা যাচ্ছে ওই ব্যক্তি কে। আর যিনি তাড়া দিলেন তিনি হরিয়ানা হ্যারিকেন। কপিল ঝড়ের সামনে হাজার হাজার কঠিন বিপক্ষের মতোই সেদিন উড়ে গিয়েছিল ডন দাউদ।
১৮ এপ্রিল, ১৯৮৬। অস্ট্রাল-এশিয়া কাপ। আমরা টুর্নামেন্টটাকে শারজা কাপ বলেও জানি। ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি। প্রথমে ব্যাট করে ভারতের সংগ্রহ ২৪৫ রান। ম্যাচটিতে সুনীল গাভাস্কার ৯২ আর কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত ৭৫ রান করেন। পাকিস্তান তিন উইকেট হারিয়ে ৬১ রান তোলে। একা উইকেটে টিকে আছেন জাভেদ মিয়াঁদাদ আর এদিকে পাকা আমের মতো এক এক করে ঝরে যাচ্ছে পাকিস্তানের উইকেট।
শেষ ওভার। ক্যাপ্টেন কপিল দেব বল তুলে দিলেন চেতন শর্মার হাতে। প্রথম বলেই ওয়াসিম আক্রাম রান আউট তিন রানে। পরের বলে মিয়াঁদাদের চার। তিন নম্বর বলে এক রান নিলেন। চার নম্বর বলে ক্লিন বোল্ড জুলকারনাইন। পাঁচ নম্বর বলে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে একটি রান আউট মিস করে ভারত।
শেষ বল। চার রান বাকি। কপিল দেব বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং ছড়িয়ে দেন। চেতন শর্মা নাড়ুগোপালের মতো বলটিকে বুকের কাছে নিয়ে ছোটা শুরু করলেন। সামনে ব্যাট উঁচিয়ে জাভেদ মিয়াঁদাদ। স্টেডিয়ামের পঞ্চাশ শতাংশ ভারতীয় আর বাকি পাকিস্তান সমর্থক। তেরঙা পতাকা আকাশে উড়ছে, ভারতের সমর্থকরা আনন্দে আকাশ-বাতাস কাঁপাচ্ছেন, আর অপর দলের সমর্থকরা একেবারে চুপ।
মুহূর্তে পাল্টে গেল দৃশ্যটা। আনন্দে ফেটে পড়ল পাকিস্তান সমর্থকরা। চেতন শর্মার হাত থেকে বলটা সরাসরি এসে পড়ল জাভেদের ব্যাটে। ফুলটস। জাভেদ মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন বলটা। ছয়। কাপ জিতে নিল পাকিস্তান। মিয়াঁদাদ করেছিলেন অপরাজিত ১১৬।
মাঠে সেদিন পাকিস্তানের জয় হয়েছিল, একথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু যেটা জানি না, সেদিন ভারতীয় ড্রেসিংরুমে নৈতিক জয় হয়েছিল ভারতের। কপিল বিক্রমে ভারত বেঁচে গিয়েছিল ম্যাচ ফিক্সিংয়ের হাত থেকে।
সেদিন ভারতের ব্যাটিংয়ের পরেই ভারতের ড্রেসিংরুমে আসেন অভিনেতা মেহমুদ। তাঁর সঙ্গে একটি লোক, ছোটখাটো চেহারা, গায়ের রঙ গাঢ় দিকে, কিন্তু ধোপদুরস্ত স্যুট, চোখে দামি রোদ চশমা। মেহমুদ বেশ বিগলিত কন্ঠে বলেন, 'ইনি একজন নামী ব্যবসায়ী। আমার বিশেষ পরিচিত। ইনি বলছেন ...'মেহমুদকে থামিয়ে লোকটি বলে, 'ভাইলোগ, পাকিস্তানকো হারানা পড়েঙ্গা। আগর হারা দিয়ে তো ম্যায় হর এক পিলিয়ারকো এক এক প্রিমিয়াম কার গিফ্ট করুঙ্গা'। প্রস্তাব শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যান ভারতীয় খেলোয়াড়রা। ভাষা শুনেও। বলে কী লোকটা! লোকটাকে তারা চেনে না এমন নয়। এমন সময় তাঁদের স্কিপার ঢোকেন ড্রেসিংরুমে। কপিল দেব ঘরে ঢুকেই বলেন, 'আরে ইহাঁপে ইতনা ভিড় কিঁউ হ্যায়? মেহমুদসাব, আপ থোড়া বাহার যাইয়ে প্লিজ়, মেরা টিমকে সাথ মিটিং হ্যায়', বলে সেই লোকটির দিকে নজর যায়। বলেন, 'অউর ইয়ে কৌন হ্যায়? তু পহলে বাহার চল'।
মেহমুদ ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, 'ইয়ে বহুত বড়া বিজ়নেসম্যান হ্যায়। সবকো এক এক কার গিফ্ট ...'।
কপিল দেব মেহমুদের কথা শেষ করতে না দিয়ে লোকটার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, 'চল, নিকল'।
লোকটি অবাক হয়ে বলল, 'আপ মেরে কো জানতে নেহি। ম্যায় ...'। কপিল দেব বললেন, 'তু যো ভী হ্যায়, আপনে ঘর মেঁ হোঙ্গে। লেকিন পহেলে ড্রেসিংরুম সে নিকল। চল চল'।
মেহমুদের সঙ্গে সেই লোকটি বেরিয়ে আসতে আসতে বলে, 'ওকে, ফির গাড়ি কানসিল'।
কপিল দেব ঘরের দরজা বন্ধ করে মিটিং শুরু করেন। মেহমুদ যাকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে নিয়ে আসেন তিনিই সেই দাউদ ইব্রাহিম কাসকর। সাধে কি তিনি "হরিয়ানা হ্যারিকেন"। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক তিনি। ওয়ান ডে ক্রিকেটে প্রথম ভারতীয় হিসেবে করেছিলেন সেঞ্চুরি। তাও সেটা ছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপের সেই বিখ্যাত জিম্বাবোয়ে ম্যাচ।
সেই ১৭৫ রানের টুর্নামেন্টে ভারতের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ইনিংস। কপিল দেব সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন ৯০৩১ রান। শিকার ৬৮৭ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেট কেরিয়ারে একবারই রঞ্জি ট্রফি জিতেছেন কপিল দেব। ১৯৯১ সালে হরিয়ানার হয়ে। অদ্ভুত ঘটনা ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ারে একবারও রান আউট হননি কপিল দেব, আর পুরো কেরিয়ারে কখনও নো বল করেননি তিনি।
১৯৭৫ সালে হরিয়ানার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল কপিল দেবের। সেই ম্যাচেই ছয় উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। এরপর ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় টেস্ট দলে অভিষেক হয় তাঁর। ১৯৮২ সালের শ্রীলঙ্কা সিরিজে প্রথমবার ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব পান তিনি। আর তারপরেই ঐতিহাসিক ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ। গোটা টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে ৩০৩ রান করার পাশাপাশি ১২টি উইকেটও নিয়েছিলেন কপিল পাজি। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন অবিস্মরণীয় ১৭৫ রানের ইনিংস।
ভারতের কিংবদন্তি অলরাউন্ডার ও ভারতকে প্রথম বিশ্বকাপ দেওয়া অধিনায়ক কপিল দেব নিখাঞ্জ। ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই অলরাউন্ডারের ভারতের হয়ে অভিষেক হয়েছিল ১৬ অক্টোবর ১৯৭৮-এ। ফয়জলাবাদে ১৯ বছরের কপিল প্রথম ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে করেছিলেন মাত্র ৮ রান, পেয়েছিলেন ১টিই উইকেট।
কিন্তু তার পরের ১৬ বছরে তিনি ভারতের হয়ে ১৩১টি টেস্ট খেলেন। ২৯.৬৪ গড়ে ৪৩৪টি উইকেট নিয়েছিলেন। ইনিংসে ৫ উইকেট ২৩বার। সেই সঙ্গে করেন ৫২৪৮ রান। সেঞ্চুরি, ৮টি। একদিনের ক্রিকেটেও সমান সাফল্য পেয়েছিলেন। ২২৫ ম্যাচে ৩৭৮৩ রান এবং ২৫৩টি উইকেট নিয়েছেন। ১৯৯৪ সালে কপিল দেব (৪৩৪) নিউজিল্যান্ডের অলরাউন্ডার রিচার্ড হ্যাডলি (৪৩১)-কে টপকে টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়েছিলেন।
ক্রিকেটের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি টেস্টে একই সঙ্গে ৫০০০-এর বেশি টেস্ট রান ও ৪০০-এর বেশি উইকেট শিকার করেছেন। এই বিরলতম ডাবল-এর রেকর্ডই অলরাউন্ডার হিসেবে তাঁর মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্য যথেষ্ঠ।
এখনও তাঁর ঝুলিতে সবচেয়ে কম বয়সী বোলার হিসেবে টেস্টে ১০০ উইকেট (২১ বছর, ২৫ দিন), ২০০ উইকেট (২৪ বছর) ও ৩০০ উইকেট (২৭ বছর, ২ দিন) শিকার করার রেকর্ড রয়েছে।
১৯৮৩ সালে আহমেদাবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্টে কপিল দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৩ রানে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন। যা তাঁকর কেরিয়ারের সেরা বোলিং। তিনিই একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে এক ইনিংসে ৯ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডের অধিকারী। তবে সেই ম্যাচ অবশ্য ভারত ১৩৮ রানে হেরেছিল। তাই হারা ম্যাচে এক ইনিংসে সেরা বোলিং-এর রেকর্ডও তাঁর দখলে রয়েছে।
১৯৯৪ সালে কেরিয়ার শেষ করার সময়, তিনিই ছিলেন একদিনের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী (২৫৩)। বস্তুত, একদিনের ক্রিকেটে তিনিই প্রথম ২০০ উইকেটের মাইলস্টোনে পৌঁছেছিলেন। নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারে অবদানের জন্য পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি।এই সব রেকর্ড বাদ দিলেও, শুধুমাত্র, ১৯৮৩ সালের লর্ডস-এর ব্যালকনি-তে বিশ্বকাপ হাতে হাসিমুখে তাঁর ছবিটির জন্যই চিরকাল ভারতীয় সমর্থদের মনের এক বিশেষ স্থানে থেকে যাবেন কপিল দেব।