সব মানুষই মরণশীল, তবে কেন বেঁচে থাকি আমরা? শুধুই বেঁচে থাকতে হয় বলে? নিশ্চয়ই নয়। এ দেহ 'খাঁচা'র মধ্যে মন-পাখি'কে ধরে রাখতেই বেঁচে থাকা আমাদের, পৃথিবীর আদি নিয়ম এই। কেউ গেয়ে, কেউ নেচে, কেউ হেসে, কেউ কেঁদে, কেউ আপদে, কেউ বিপদে, কেউ রক্ষায়, কেউ ধ্বংসে, কেউ লিখে, কেউ পড়িয়ে -যার যার মত করে প্রত্যেকে লালন করে সে পাখি। কিন্তু অনেক সময় এও দেখা যায় যে, খাঁচা-পাখি দুইই আছে অর্থাৎ দেহ-মন যে যার জায়গা মতনই রয়েছে, তবে তা অসাড়-বিকল। সাড়হীন দেহ-মনে দম না দিলে সে জীবন মৃত বলেই ধরা যেতে পারে। সিনেমার রিভিউ করতে গিয়ে এসব লিখছি কারণ শিবপ্রসাদ-নন্দিতা -এই পরিচালক জুটি বাংলা সিনেমার সাড়হীন দেহ-মনে দম দিয়ে সঞ্জীবনী এনেছেন এবং তৈরী করেছেন বাংলা সিনেমার নব্য ভাষা। ডুবুরী হয়ে তাঁরা নেমে পড়েছেন মানব মন-সমুদ্রে, সেই অতলে যা যা অসামঞ্জস্যতা-বিকার-জটিলতা-অসহায়তা তা কুড়িয়ে পাচ্ছেন তাঁরা একে একে সবই প্রয়োগ করছেন তাঁদের একের পর এক চলচ্চিত্র ভাবনায় এবং ফের তা ধরা পড়েছে তাঁদের 'কন্ঠ'-এ।
একজন গায়ক, বাচিক শিল্পী'র কাছে অপরিহার্য তাঁর 'কন্ঠ', মন-মগজ-হাত-পা-পেট সব যন্ত্রই এসে 'কন্ঠে' মেশে তাঁদের। সেই কন্ঠই যদি অবরুদ্ধ হয়, সেক্ষেত্রে দশা টা হয় ঐ সাড়হীন খাঁচা আর পাখির মতন। এই ছবির প্রটাগনিস্ট অর্জুন মল্লিক(শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)-এর গল্পটা তেমনই। অর্জুন মল্লিক একজন বাচিক শিল্পী, পেশায় রেডিও জকি বা উপস্থাপক। তার প্রতিষ্ঠিত-উদ্দীপ্ত জীবনের ফাঁকে কখন যে বাসা বেধে বেড়ে উঠেছে অযাতিত কর্কট রোগের নির্মম আগ্রাসন তা সে ততক্ষণ টের পায় না যতক্ষণ না তার সাধনার কন্ঠ হঠাৎই একদিন দুম করে রোধ হয়ে আসে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কাঁচা রক্ত। রাজ রাজাকেও ভিখারী-নিঃস্ব বানিয়ে ছেড়েছে যে রাজরোগ, যে রোগে মানুষ তিলতিল করে অনুভব করে জীবন ফুরিয়ে আসা, সেই রোগের শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় অর্জুন, মুখোমুখি হয় সেই অমোঘ সত্যের। বাঁচা উপায় একটাই- বাদ দিতে হবে বেঁচে থাকার রসদকেই। স্ত্রী পৃথা(পাওলি দাম) ও একমাত্র সন্তানের ভাবনায় সে বাধ্য হয় অসাড় ভাবে বেঁচে থাকাকে মেনে নিতে। তাইই হয়, জীবন রক্ষা হয় অর্জুনের। কিন্তু সে জীবন নিয়ে কী করবে অর্জুন? সবকিছুই তো পাল্টে গিয়েছে, কাজের পরিসর হারিয়েছে সে, হারিয়েছে ভোরবেলার রেওয়াজ, দেখেছে বাবাকে দেখে সন্তানের আতঙ্ক, স্ত্রী'র গুমোট আর্তনাদ, কন্ঠের বদলে তার গলায় ঝুলেছে সাদা স্লেট-মার্কার, ডিপ্রেশনের তমসা। পরিবার-বন্ধুদের ভরসা-ভালোবাসা সত্ত্বেও সাদা স্লেটে কালো কালি দিয়ে ‘একা থাকতে চাই’ লিখে দেয় সে। কিন্তু সকলে আরও আঁকড়ে ধরতে চায় অর্জুনকে, সকলেই চায় পালিয়ে গিয়ে নয়, নতুন জীবনকে নতুনভাবে স্বাগত জানাক সে। ভালোবাসার মানুষদের নাছোড়বান্দায় অর্জুনও বেরিয়ে আসতে চায় একাকিত্বের মায়াজাল থেকে। ফেরেস্তার মত তার পাশে এসে দাঁড়ায় এক প্রথাবিরুদ্ধ মুক্তমনা স্পিচ থেরাপিস্ট রোমিলা চৌধুরী (জয়া এহসান)। অবসাদের ফাঁপড়ে না পড়ে নিজস্ব প্রচেষ্টায় আড়ষ্টতা ভেঙে যেটুকু সম্বল তাই নিয়ে কীভাবে এগিয়ে চলতে পারা যায় অর্জুনকে ধরে ধরে তারই পাঠ দিতে থাকেন তিনি। ‘কন্ঠে’র লড়াই টা শুরু হয় সেখান থেকেই।
আন্তর্জাতিক পরিসরে সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে 'কন্ঠ'-র মতো বিষয়বস্তু প্রাধান্য পায়নি এমনটা নয়, কিন্তু জীবনকে উপলব্ধি করা, মৃত্যুকে চাক্ষুষ করা, মৃত্যু অথবা হতাশার কাছে নতি স্বীকার না করার অদম্য মানসিকতাকে বাংলা সিনেমায় এভাবে এই প্রথম তুলে ধরেছেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধায়-নন্দিতা রায়। তাঁদের একের পর এক ছবিতে ড্রামা-নস্ট্যালজিয়া-অভিনয়-ইতিবাচকতা -এগুলির বুনোট এতটাই পাকাপক্ত হয় যে সিনেমার দুর্বল জায়গাগুলো প্রাধান্য এবং পাত্তা না পাওয়ার জোগাড় হয়। নিজেদের স্বতন্ত্র ভাবনাকে নাটকীয় মোড়কে ইতিবাচক রূপ দেওয়ার জন্যে ছবিটি নির্মেদ হতে পারেনি, এই হল এই ছবির দুর্বলতা। অর্জুন এর ভূমিকায় শিবপ্রসাদ একেবারে নিখুঁত, ছবিতে জয়া এহসান-কে দেখে আপনার মনে হবেই, 'এমন কেন সত্যি হয় না আহা...!'। পাওলি দাম এই ছবিতে আরও একবার প্রমান করেছেন তিনি পারেন, কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রীর কাছে ছবির অন্যতম সেনসিটিভ মুহূর্ত ধরা হয় ভেঙে পড়ার দৃশ্যগুলো, একটু এদিক-ওদিক হলেই ছবির মেজাজ হারানোর ভয় থাকে, সেদিক টা দারুণ সামলেছেন তিনি, উপযুক্ত। এছাড়াও পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্রা সেন, তনিমা সেন -এঁদের অভিনয়-প্রাজ্ঞতা এ ছবিতেও ধরা পড়েছে, ছবির 'মুড'-কে অচিরেই ব্যালেন্স করেছেন তাঁরা। কনিনীকা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাল। ছবির গান- মনে করতে পারবেন এমনই। দীপাংশু আচার্যের কলমে, প্রসেনের সুরে, সাহানার গায়কিতে 'সবাই চুপ' অনবদ্য, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের 'বর্ণপরিচয়'ও তাই। তবে শুধু 'ল্যারিংজেকটমি' ভুক্তভুগীদের জন্য নয়, শিবপ্রসাদ-নন্দিতার 'কন্ঠ' উন্মুক্ত হয়েছে সকলের জন্যই, হতেও পারে আপনার জীবনের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার গল্প হয়ে উঠবে এ ছবিই, আর তাই হাল না ছেড়ে, একবার হলেও ছাড়ুন থুড়ি দেখে ফেলুন 'কন্ঠ'।