রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘরানায় যে ক'জন বাঙালীর নাম সবার প্রথম মনে আসে তাঁদের মধ্যে অন্যতম সকলের প্রিয় 'মোহরদি' ওরফে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর জীবনের সবটুকু জুড়ে ছিল শান্তিনিকেতন আর রবীন্দ্রনাথের গান।
রবীন্দ্রনাথের টপ্পা আঙ্গিকের গানে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিষ্যা, কেবল গানে নয়, উপলব্ধিতেও। তাই তো সংগীতকে জীবন-সাধনায় একাত্ম করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অতুলপ্রসাদের গানেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন, যদিও এই ধারায় তাঁর রেকর্ড সংখ্যা খুব বেশি নয়। তিনি যেমন গান গাইতেন, তেমনই ছিল তাঁর গায়নভঙ্গি; নিমিষে সকল ভক্ত-শ্রোতার মন জয় করে নিতেন।
১৯২৪ সালের ১২অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে জন্মগ্রহণ করেন কণিকা বন্দোপাধ্যায়, তাঁর পিতৃদত্ত নাম অনিমা মুখোপাধ্যায়। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারের কর্মী ও মা অনিলা দেবী ছিলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমজননী। তাঁদের পাঁচ কন্যা ও তিন পুত্রের মধ্যে কণিকা ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ছেলেবেলা কাটে বিষ্ণুপুরের মামাবাড়ির যৌথ পরিবারে। পরে খুব অল্পবয়সে পিতার কর্মস্থল শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। ভর্তি হন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে।
তাঁর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় এই সময় এক কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় উত্তরায়ণের বাগানে আম চুরি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। সহজাতসঙ্গীত প্রতিভার কারণে তিনি সেই বয়সেই কবির বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে পড়েন। ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অণিমা’ নামটি পরিবর্তন করে ‘কণিকা’ রাখেন। তবে তাঁর ডাকনাম 'মোহর' নামে তিনি ছিলেন সর্বজনবিদিত। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই 'মোহর' নামটি আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে নাম রাখেন 'আকবরী মোহর'। ১৯৯৩ সালে বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ তাঁকে কেন্দ্র করে 'মোহর' নামের একটি তথ্যচিত্রও বানিয়েছিলেন। এমনকি কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর এই 'মোহর' নাম টি। কীভাবে? তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল লাগোয়া বিখ্যাত সিটিজেন্স পার্কটিকে তাঁর নামে উৎসর্গিত করা হয়, বর্তমানে যার নাম 'মোহরকুঞ্জ'।
হরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে নিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদী গানের তালিম, এছাড়াও কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগমের কাছে শিখেছিলেন নজরুলের গান। ভজন, কীর্তন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানও রেকর্ড করেছিলেন তিনি। ১৯৪৩ সালে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন কণিকা। ১৯৮৪ সালে সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে অবসর নেন কণিকা। তাঁর শেষজীবন কাটে শান্তিনিকেতনে। অসুস্থতার কারণে শেষদিকে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০০০ সালের ৫ এপ্রিল কলকাতাতেই তাঁর জীবনাবসান হয়। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এখনও কানে বাজে তাঁর গায়কী-
তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি--
তবু মনে রেখো।
যদি জল আসে আঁখিপাতে,
এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।
এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে-- মনে রেখো।
যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে--
তবু মনে রেখো।