প্রথম কদম ফুল ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

কালুর হাতটা কাঁপছে। মুখে দ্বিধা, ভয় আর কিছুটা সাহস। হাতে এক চিঠি প্রেম। চিঠিটা যে প্রেমের হতে পারে, কিশোরী মোহর ভাবেননি। অবশ্য, না ভাবার তো কারণ নেই! এরমধ্যে কালু তাঁকে হৃদয়ের কথা বুঝিয়ে দিতে কম চেষ্টা তো করেনি। যেমন : সমবয়সী বা বছর দুয়েকের বড় হয়েও কালু এতদিনে কিছুতেই 'তুমি' ছাড়া 'তুই'-তে নেমে এলো না; চোখে দেখতে পায় না সে, তবুও কেমন করে যেন অনেকের মাঝে এবং একক মোহরের উপস্থিতি বুঝে ফেলে তাঁকে তাক লাগিয়ে দেয়; মোহরের কণ্ঠসৌন্দর্যের প্রশংসা করতে গিয়ে মনে মনে আঁকা রূপসৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়, এতে মোহর খুশি হন, সে প্রশ্রয় পায়; সঙ্গীত নিয়ে তর্ক বাঁধলে, মোহরের অভিমান হলে, তার কষ্ট হয়, তখন সে-ই আগবাড়িয়ে মানভঞ্জন করে; মোহরকে একা পেলে কিছু একটা বলতে চায়, অথচ বলতে পারে না--এতকিছুর পরও আর কেমন করে কালু না-বলেও বোঝাবে তার ভালোবাসার কথা? আর মোহর যদি তা না-ই বুঝবেন, তাহলে তাকে এ-সময় থেকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন কেন?

কালুর সঙ্গে প্রথম যখন দেখা হল, তখন মোহর নিতান্তই বালিকা।  ফকিরের হাত ধরে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে গান গেয়ে ভিক্ষে করতে হঠাৎ একদিন গুরুপল্লিতে এলো সে। তার কণ্ঠ ভেসে এলো পথ থেকে ঘরে। সেই কণ্ঠের এমন মাধুর্য, মোহরকে ঘরে থাকতেই দিল না; টেনে আনল পথে। শুধু টানলই না পাগল করে সারাটা পাড়া নাকে দড়ি দিয়ে কালুর পেছন পেছন ঘুরিয়ে ছাড়ল। গুরুপল্লির সবারই ভালো লাগল ছেলেটির গান। শিল্পী নন্দলাল বসুরও  চোখে পড়ল সে। প্রথম দিন এতো ভালোবাসা পেয়ে সে যেন কৃতার্থ হয়ে গেল। তারপর নিত্যই আসতে শুরু করলো। সঙ্গীতে ছেলেটির প্রতিভা আছে দেখে নন্দলাল তাকে কলাভবনে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন আর সঙ্গীতভবনে শিক্ষার। আসতে-যেতে গান শুনিয়ে মোহরের সঙ্গে ভাব তার আগেই হয়েছিল, এখন সঙ্গীতভবনে সতীর্থ হল। কালু খুব দ্রুত রবীন্দ্র সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত এবং সেতার বাজানো শিখতে লাগল। অল্পদিনেই আশ্রমের নানান অনুষ্ঠানে-সঙ্গীতে সে অপরিহার্য হয়ে উঠল। ভিখারি কালু এতদিন গান দিয়ে মানুষের মন জয় করেছে, এবার কি একজন মানুষীর হৃদয় জয় করতে পারবে না? মোহরের কণ্ঠের সুর যে তাকে আমূল ছুঁয়েছে, সে কি ছুঁতে পারবে না?  তার হৃদয় জেগেছে, সেই হৃদয় সমস্ত অতীত ভুলিয়ে মোহরের দিকে প্রবলভাবে টানছে, তাকে প্রেম নিবেদনে বাধ্য করছে! না, মুখে বলতে সে বোধহয় পারবে না। চিঠি, হ্যাঁ চিঠিতেই জানাবে সে।

কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়েই প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল লজ্জিত কালু। মোহর চিঠিটা পড়লেন। "প্রেমপত্র। কাকে দিয়ে লেখাল? হয়তো কলাভবনের কোন ছাত্রকে দিয়ে। কিছুই ভাবতে পারছি না এ কি করে সম্ভব? এক অন্ধ, অনাথ। কী স্পর্ধা! রাগে তখন আমি ফেটে পড়ছি। এ সাহস ওর হল কি করে?" রাগের কারণটা অত্যন্ত স্পষ্ট। কালু শ্রুতিতে আছে, স্বপ্নে তো নেই। গান ভালোবাসলেও মানুষটাকে তো তিনি ভালোবাসেননি। আর তাছাড়া কালু অন্ধ, কালু অনাথ, কালু ভিখারি, কালু মুসলমান। তার একটাই সম্পদ, গলায় সুরের ঝর্ণাধারা। আজন্ম সংস্কারে শুধু এটুকুর জন্য করুণা করা যায়, তার কণ্ঠকে ভালোবাসা যায়; কিন্তু তাকে ভালোবাসা যায় না!

আশ্রমে বেশ একটা হৈ চৈ পড়ে গেল। কারণ, রেগে গিয়ে এই চিঠির কথা মোহর বন্ধুদের তো বললেনই, সেই সঙ্গে অধ্যক্ষকেও দেখিয়ে দিলেন। ফলে, অনুগ্রহ-আশ্রিত কালুর কপালে ভর্ৎসনা জুটল। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হল সে ভয়ানক এক গর্হিত অপরাধ করেছে! অসম্ভব আঘাত পেল কালু। নিজেকে সে গুটিয়ে নিতে শুরু করল। মানুষ যাকে অন্তর দিয়ে চায়, তার কাছ থেকে আঘাত পেলে সেটা একেবারে বুকের ভেতরে গিয়ে লাগে। মোহর এ-সময় রাগের বশে এমন নিষ্ঠুর হয়ে গেলেন যে, আরও আঘাত দিতেই যেন তাকে দেখলেই 'অন্ধ', 'কানা' বলে ডাক দিতে লাগলেন। যে প্রতিবন্ধকতাকে কালু ভুলে গিয়েছিল, তা-ই আবার তার সামনে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াল। নিজের ঘর থেকে প্রায় বেরোনোই বন্ধ করে দিল, সঙ্গী হল শুধু গান আর সেতার। কিন্তু তাতেও তার বুকের জ্বালা কিছুতেই মিটল না। তারপর এলো এই অন্ধ মানুষটার অবলম্বনহীন অস্থিরতার পালা। তখনই সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে ফেলল, কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ল নিরুদ্দেশের পথে। 

ফিরে আসার জন্য আশ্রম ছাড়েনি কালু। ফিরেও এলো না। তবে কিছুদিন পর কেমন করে যেন তার মৃত্যুর খবরটা এলো। সত্তা থেকে তো হারিয়েই ছিল, স্মৃতি থেকেও কালু হারিয়ে গেল। কেটে গেল ছ' সাতটা বছর। অনেকদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে মোহর বেড়াতে গেলেন। ফতেপুর সিক্রি। কানে ভেসে এলো একখানা গজল, তার সুরে হৃদয় নিংড়ানো ভৈরবী। একটা গান তাঁকে বালিকাবেলায় ঘর থেকে পথে এনেছিল; এ গানও তাঁকে টেনে নিয়ে চলল গায়কের কাছে। গানটা শুনেই মনে একটা প্রত্যাশা যেন জেগে উঠল, জেগে উঠল একজন বিরহীর মুখ, বুকের ভিতর দলাপাকানো একটা কষ্ট, আর বেড়ে উঠল একটা সহৃদয় বুকে মুখ রেখে অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলার আকাঙ্ক্ষা! ঝাপসা চোখে হাজির হলেন সিঁড়িতে। হতাশ হলেন মোহর। না, কালু নয়। এক অন্ধ মুসলমান যুবক হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শুনিয়ে ভিক্ষে করছেন। বুক ঠেলে বেরিয়ে এলো কান্না। তাহলে, কালু ছিল। 'হিয়ার মাঝে লুকিয়ে' ছিল। রবীন্দ্রনাথের নবরত্নের এক রত্নের মেয়ে মোহর, রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদধন্যা মোহর, বর্ণব্রাহ্মণ মোহর দেখতে পাননি। এতদিনে মনে হল, বিরহের গান শুনে যেভাবে আজ তাঁর হৃদয় খাঁ খাঁ করছে;  বিরহ যন্ত্রণায় সেদিন কালু নিশ্চয় এর থেকেও দুঃসহ জীবন কাটিয়েছে! হৃদয়ের দুয়ার খুলল। তবে বড্ড দেরি হয়ে গেল। মানুষটা যেন গোপন পথে জীবনে এসেইছিল চলে যাবে বলে, হৃদয়ের উপলব্ধির স্তরগুলোকে জাগিয়ে দেবে বলে; সে তার এক অমূল্য দান, বুকে রাখার ধন--

"আমার    প্রাণের 'পরে চলে গেল কে

বসন্তের   বাতাসটুকুর মতো।

সে যে    ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে--

ফুল      ফুটিয়ে গেল শত শত।

সে চলে গেল, বলে গেল না-- সে   কোথায় গেল ফিরে এল না।"

কাহিনি ও উদ্ধৃতি ঋণ:আনন্দধারা (আত্মজীবনী)- কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

গীতবিতান- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...