কাঞ্চনজঙ্ঘাঃ বাংলা সিনেমার এক মাইলফলক

কাঞ্চনজঙ্ঘাঃ বাংলা সিনেমার এক মাইলফলক

সন ২০২১ সত্যজিত রায়ের জন্ম শতবর্ষ। সন ২০২২ কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির হীরকজয়ন্তী বর্ষ। সত্যজিতের এই ছবি বাংলার প্রথম রঙিন সিনেমাও বটে। ১৯৬২ সালে তৈরি সিনেমা আজও বাঙালির কাছে অনেক না বলা কথার হাতছানি। কাঞ্চনজঙ্ঘা বললেই প্রথমেই মনে হয় দার্জিলিং ম্যাল, কুয়াশার খেলা আর মেঘকোলে সেই শৈলচূড়ার বৃত্তান্ত।

Ray_first-colour-film 

প্রথম স্ক্রিপ্ট অনুযায়ি, এটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটেই করার কথা ছিল, এবং গল্পের পটভূমিও একটু আলাদা ছিল। তারপর দার্জিলিঙে ফাইনাল স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় প্লট চেঞ্জ করেন এবং বাংলা পায় তার প্রথম কালার সিনেমা। এটা উনি নিজেও লিখেছেন এবং বিজয়া রায়ের লেখাতেও আছে এই রঙিন ছবির ভাবনার বিষয়টা। আগে সিনেমাটার নাম দেওয়া হয়েছিল সম্ভবত ‘বাগান বাড়ি’। পরে দার্জিলিঙে গিয়ে লেখার সময় বাকি পরিবর্তন। এবার সিনেমাটা যখন কালারে হলো, একটা অন্য জগতে নিয়ে চলে গেল। ওই মেঘ, ওই কুয়াশা, ওই লম্বা লম্বা ফার্ণ আর দেবদারু গাছের ছায়া, ওই ঘণ্টার শব্দ সব মিলিয়ে একটা আলাদা জগৎ সৃষ্টি করে। যদিও সিনেমার শেষে গিয়ে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে পাই। যেটা কলকাতার প্রাত্যহিক জীবনের বাইরে গিয়ে।

অশোক (অরুন রায়) যে চাকরী প্রার্থী, সে ওখানে চাকরীর অফার পেয়েও তা নেয় না, পরে অবশ্য আফসোস করে। আফসোস করার সময়ও বলে, এই পরিবেশ তাকে একটা যেন কেউকেটা করে দিয়েছে। প্রকৃতিও এখানে একটা চরিত্র হয়ে উঠলো। সেই জন্যই উনি রঙের ব্যবহার করলেন। এবং যে রঙের ব্যবহার করলেন তাকে আমরা 'রায়টস অফ কালার' বলতে পারি। কোনটার সঙ্গে কোনটার মিল নেই। আবার তার সঙ্গে পোশাকের রঙ খুব ভেবেচিন্তে ব্যবহার করছেন। সব রঙের মধ্যে একটা সংযম আছে। সাংঘাতিক উজ্জ্বল রঙ কিন্তু নেই। আর যেহেতু প্রকৃতির সঙ্গে মানুষগুলো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে তাই প্রকৃতির রঙও চাপা রাখা হয়েছে। উনি যে রঙটা ব্যবহার করছেন সেটা পয়েন্টিঙের মতো। আমার তো মনে হয় উনি শান্তিনিকেতনে এই ধারাটা পেয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ যে 'ওয়াশ টেকনিক' ব্যবহার করতেন, সেই এফেক্টটাই মানিকদা সিনেমাটায় ব্যবহার করেন। রঙ আছে, কিন্তু রঙ নেই।  

কিছু দিন আগে সিনেমার মনীষার (অলকানন্দা রায়) সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাকে পোশাকে রঙের ব্যবহার নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম। যেমন পোশাকের ক্ষেত্রেও তার শাড়ির রঙ হলুদ, যার চরিত্রর ক্ষেত্রেও মুক্ত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। আবার তার দিদির ক্ষেত্রে ডোরা কাটা শাড়ি, যার মনের মধ্যে দুটো সম্পর্কের টানা পোড়েন। বা আপনার মামা যেহেতু বার্ড ওয়াচ করেন তাই তার সবুজ ব্লেজার। এই ব্যবহারগুলোও খুব সিগনিফিকেন্ট।

download (12)

উত্তরে অলকনন্দা রায় বলেন, "একদমই ঠিক বলেছ, আমার শাড়ি গয়না, মানিকদার কেনা। কোটের কাটিং, কাপড় সবই ওঁর ঠিক করা। আমি শুধু গিয়ে মাপ দিয়ে আসি। খুব সচেতনভাবে নাহলেও আমরা যখন কোনও সিনেমা দেখি, দেখবে পোশাকের রঙ কিছুটা হলেও চরিত্রর একটা গড়ন তৈরি করে দেয়। শাড়ি নিয়ে আমার প্রথমে একটা অভিযোগও ছিল, কোন ছাপ নেই, এইরকম শাড়ি কেন? তো উনি প্রশ্ন করলেন, তোমার দিদির শাড়িটা দেখেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ, সেই জন্যই তো বলছি। তখন উনি আমায় বললেন, ওর জীবনটা কিন্তু অসুখী দাম্পত্যে বন্দি জীবন। ওই ডোরাকাটাটা জেলের গারদের কথা মনে পড়ছে না? আর তোমার জীবন তো খোলা আকাশের মতো। সবে সূর্যটা উঠছে তো। তাই সূর্যোদয়ের রঙের শাড়ি তোমার। এই যে ভাবনাটা উনি আমায় বোঝান। ছবিবাবুর বেগুনি রঙের স্যুট, আভিজাত্যের রঙ। মামা জঙ্গলে ঘুরে বেরান তাঁর সবুজ ব্লেজার। আবার কিছু পোশাকের রঙ বদলানো যাবে না। মা লাল পাড় গরদই পরবেন, বা নিম্ন মধ্যবিত্ত কাকা ভাইপো। বিশেষ করে অশোক বলছেও, 'এই প্যান্টটাও তো ধার করা'। সেখানে রঙের কোনও সিম্বল নেই।"

সিনেমায় প্রকৃতিকেও সত্যজিৎ রায় একটা চরিত্র হিসাবে ট্রিট করছেন। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সম্পর্ক গুলোর লেয়ার নিয়ে খেলছেন। কুয়াশাকে খুবই সিগনিফিকেন্ট ভাবে ব্যবহার করেন উনি। মানুষের মনের মধ্যেকার যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভাবনাচিন্তা গুলো যখন খুব পরিষ্কার নয় সেগুলো কুয়াশার প্রতিটি পরতে খুব ভালোভাবে প্রকাশ করেছেন। একটা জায়গায় মিঃ ব্যানার্জী আর মনীষা যখন হাঁটছিল তখন হঠাৎ করে এতো কুয়াশা আসে যে মিস্টার ব্যানার্জী মনীষাকে আর দেখতে পান না। সেই সুযোগে মনীষা চলে যায়। সেখানে কুয়াশা যেমন আড়াল, তেমনি ব্যানার্জী কিন্তু মনীষাকে বুঝতেই পারছেন না, দেখতেই পাচ্ছেন না। মনীষার যে ভাবনা চিন্তার জগৎ সেটা কিন্তু ব্যানার্জী ধরতেই পারছে না।

সিনেমার শেষে যখন টেনশন গুলো কেটে যাচ্ছে, মনীষার দিদি আর শঙ্করদা ওদের মেয়ের জন্য বাকি সব ছেড়ে এক হচ্ছে, মনীষা নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আর ধীরে মেঘ কেটে কাঞ্চনজঙ্ঘাও পরিষ্কার হচ্ছে।

সুব্রত মিত্র আর অনন্ত দাসের একটা অসাধারণ যুগলবন্দীও এই সিনেমা। কেউই তখনও রঙিন ছবির কাজ করেননি। আর ইস্টম্যান কালারে পরে সেই মেকআপের রঙ কেমন হওয়া উচিত, সেটা অনন্তবাবু কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। দার্জিলিঙ গিয়ে সত্যজিৎ বাবুকে উনি অনুরোধ করেন মেকআপের পর ছবি তুলে যদি আমায় রঙটা দেখান। কিন্তু তা তখন সম্ভব হয়নি, কারণ তখন দার্জিলিঙে কোন প্রিন্ট স্টুডিও ছিল না। ফলে কলকাতায় পাঠিয়ে প্রিন্ট করে যেতে এক সপ্তাহ লাগবে। ফলে তিনি হাতের আর চোখের আন্দাজেই সমস্ত মেকআপ করেন অনন্ত দাস। একটু আগে যে কথা হচ্ছিল, প্রকৃতি একটা চরিত্র। তা ক্যামেরাবন্দি করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব সুব্রত মিত্রর।

যে গান দিয়ে সিনেমা শেষ হচ্ছে সেই সুরটা কিন্তু প্রথমে টাইটেল কার্ড দেখানোর সময়ও ব্যবহার হয়েছে। বাচ্চাটাকে, মানে যে গানটা গাইল তাকে আমরা ঘন্টাখানেক বাদে দেখতে পাই। এই বিষয়ে অলকনন্দা রায় বলেন "শুনেছি, মানিকদা স্ক্রিপ্ট করতে গিয়ে এই গানটা ওকে গাইতে শোনেন। তারপরই মনস্থির করেন গানটা রাখার ব্যাপারে। ওর বাড়ি গিয়ে তখনই কথা বলে আসেন। এটা একটা ব্যাপার। আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় এই বাচ্চাটা যে গানটা গাইছে, তার কথাটা ছিল 'মানারকলি হাসা লাওলা'। মানে মন খুলে হেসে নাও, প্রাণ খুলে হেসে নাও, আনন্দ কর। আর অত্যন্ত ধনী পরিবারের একজন মহিলা গাইছেন 'এ পরবাসে রবে কে'। এই পৃথিবীটা তার কাছে পরবাস হয়ে গেছে। আর দরিদ্র ভিখিরি বাচ্চা তার গানে আনন্দ। এই কনট্রাস্টটা ভেবে দেখেছ? সোজা ভাবে বুঝিয়ে দিলেন টাকার সঙ্গে সুখের কোন সম্পর্ক নেই"। 

কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার দেখা প্রথম রিয়েল টাইম সিনেমা। যেখানে সিনেমা যখন শুরু তখন চারটে বাজে। আর সিনেমার দৈর্ঘ বিচার করলেও ওই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ম্যালে অন্ধকার হয়ে আসে। এখানে রিল টাইম আর রিয়েল টাইমটা একই। এটাও তখনকার সময় একদমই আলাদা।

নিবন্ধকারঃ ঋদ্ধি রিত

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...