গায়ক-সুরকার পঙ্কজ মল্লিক কানন দেবীকে বলতেন, ‘ফার্স্ট সিঙ্গিং স্টার অব নিউ থিয়েটার্স’। শুরু থেকেই সবাক ছবিতে কানন গান গেয়েছেন। তবে তাঁর গানের রেকর্ড প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে, মেগাফোন কোম্পানি থেকে। কিন্তু এই সময় পর্বে কী ছবিতে, কী রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার সুযোগ তিনি পাননি; পেলেন আরও দু’বছর পরে। সেটা কীভাবে ঘটল, সেটাই বলছিঃ
পারিবারিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে তাঁর শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও পড়াশুনোর সুযোগ কানন পাননি। সিনেমায় অভিনয় করতে এসেছিলেন নেহাতই পেটের দায়ে। অভিনয় করতে করতে যখন তাঁর স্বচ্ছলতা এল, তখন তাঁর ভেতরের পাঠলিপ্সু সত্তাটি আবার জেগে উঠল। এর আগেই তিনি উপলব্ধি করছিলেন যে, শিক্ষা না-থাকলে এই শিল্পে টিকে থাকা যাবে না। সুতরাং, অবিলম্বে তিনি পুরাণসহ সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্য পড়ে শোনানোর জন্য একজন পণ্ডিত রাখলেন, ইংরেজি শেখানোর জন্য একজন শিক্ষিকা রাখলেন, আর বাংলা কাব্য-নাট্য-গল্প-উপন্যাস পড়ে শোনানোর জন্য একজন মাস্টারমশাই রাখলেন।
আগে রবীন্দ্রনাথের গান শুনলেও মাস্টার মশাইয়ের কাছেই তাঁর সম্যক পরিচয় প্রথম পেলেন কানন। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের অপরাপর রচনার পাঠ শুনে অপার মুগ্ধতায় ধন্য হলেন। উপলব্ধি করলেন তাঁর অনুভবের মহত্ব। সেই প্রথম পরিচয়ের কথা বলতে গিয়ে ‘সবারে আমি নমি’ নামের আত্মকথায় কানন বলেছেন, ‘…রবীন্দ্রনাথের ঋষির মত চেহারা মন টানত। কিন্তু ঐ মহাসাগরের তীরে বসে মুগ্ধ বিস্ময়ে ঢেউ-ওঠা ও পড়া দেখার বেশী অন্য কিছু দেখার আশা যে দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এইটুকুই শুধু অনুভব করতে পেরেছিলাম।’
কিন্তু আমাদের মতে, এ হচ্ছে প্রথম পরিচয়ের বিস্ময়, আত্মদীক্ষার বিনয়। কারণ, রবীন্দ্রনাথকে ক্রমে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন, কন্ঠস্থ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতায় নিজের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। আর সেজন্যই বোধহয় একদিন আশ্চর্য যোগাযোগ ঘটে গেল তাঁর জীবনে। তাঁর কণ্ঠ ও লিপে রবীন্দ্রনাথের গান প্রথম সিনেমায় স্থান পেল। সে এক দারুণ ঐতিহাসিক ঘটনা। যা ঘটিত হল, ১৯৩৭ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ও অভিনীত ‘মুক্তি’ ছায়াছবির মধ্য দিয়ে।
‘মুক্তি’-তে অভিনয় করতে এসেই যে রবীন্দ্রনাথের গান কাননের কণ্ঠে প্রথম উঠল, এমনটা নয়। বাল্যে মায়ের সঙ্গে ভাড়ার যে জীর্ণ কুটিরে কানন থাকতেন, তার পাশেই থাকতেন ভাগ্যহীন নিঃসঙ্গ ভোলাদা। স্ত্রী-পুত্রকে হারিয়ে ভোলাদা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন। মনের মধ্যে দুঃখ ঘনালেই শূন্য দাওয়ায় ভাঙা হারমোনিয়াম নিয়ে একের পর এক গান গেয়ে বুক ভাসাতেন। অন্তরের অনুভব কীভাবে ছায়াছবি করে তুলতে হয় গানে, তা ভোলাদার গান শুনে সেই বয়সেই উপলব্ধি করেছিলেন কানন। তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনতেন, চোখ ভেজাতেন। আর অন্তরে গ্রহণ করতেন কণ্ঠে অনুভবের রঙ ছড়ানোর জাদু।
ভোলাদা কাননকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মন ভালো থাকলে গানও শেখাতেন। তাঁর কাছেই কাননের গানে হাতেখড়ি। মীরার ভজন, কীর্তন, অতুলপ্রসাদী এবং রবীন্দ্রনাথের দু’চারটি গান তিনি ভোলাদার কাছেই শিখেছিলেন। তারপর পুনরায় রবীন্দ্রনাথের গান শেখার সুযোগ হল স্বয়ং রবীন্দ্রস্নেহধন্য পঙ্কজ মল্লিকের কাছে। ‘মুক্তি’র শ্যুটিং-এর ঠিক আগে। তাঁর কাছে কাননের প্রথম শেখা গান, ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’।
শিখতে এসে সুরসম্পদের অতুল অধিকারী এই মানুষটিকে দেখে গভীর শ্রদ্ধায় কানন তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান শেখানোর একটি চমৎকার রীতি ছিল পঙ্কজের। তিনি গানটির দর্শন এমন করে হৃদয়ে বুনে দিতেন যে, কাননের মতো সাধক-শিক্ষার্থীরা সহজেই অনুভবটিকে উপলব্ধি করে পরিবেশন করতে পারতেন অন্তর দিয়ে।
শেখানোর সময় কাননকে পঙ্কজ প্রায়শই মনে করিয়ে দিতেন, ‘‘মুক্তি’ বইতে তোমার মুখেই প্রথম সবাই রবীন্দ্রসংগীত শুনবেন। দেখো কবির গানের মর্যাদা এতটুকুও ক্ষুন্ন না হয়। দেবতার চরণে অঞ্জলি দেবার সময় যেমন একাগ্রচিত্ত হয়ে, বিনত হয়ে মন্ত্রপাঠ করতে হয় ঠিক তেমন করেই এ গান গাইতে হবে।’ এই মন্ত্র মাথায় নিয়ে সেরকম নিবেদিতপ্রাণ হয়েই কানন গেয়েছিলেন তাঁর শেখানো গান। তাই কাননের কণ্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ সিনেমার পর্দা পেরিয়ে সাধারণের লিপে উঠে আসতে পেরেছিল। এভাবে রবীন্দ্রনাথের গানও নির্বিশেষের হয়ে উঠতে পেরেছিল সেদিন। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছিল।
‘তার বিদায় বেলার মালাখানি’। এটি ‘মুক্তি’র দ্বিতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীতটি। এই গানটিও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। অনুভবের দিক থেকে প্রথম গানটির চাইতে কাননের নিজের বেশি ভালো লেগেছিল এই গানটিই। কেন? তার উত্তর কানন নিজেই দিয়েছেন, ‘ও গানটা যেন আমায় ‘হন্ট’ করত। আর গাইবার সময় পঙ্কজবাবুর গাইবার ভঙ্গিটি অজ্ঞাতেই অনুসরণ করেছিলাম বলেই হয়ত এ গানের অভিব্যক্তি রসিক শ্রোতার এমন বিপুল অভিনন্দন পেয়েছিলো।’ আসলে, গান ও গায়িকার অন্তরের ভাঙাগড়া এই গানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
এভাবে অন্তরের অনন্ত ভাব এমন একাত্মভাবে প্রকাশ করতেই ছায়াছবিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্যবহার শুরু হল ‘মুক্তি’ দিয়ে। শুরু হল রবীন্দ্রনাথের গানকে সাধারণের ঘরে ঘরে ঠোঁটে ঠোঁটে পৌঁছে দেওয়ার সাধনা। তারপর এই ধারা চলতেই লাগল একের পর এক ছবিতে। হেমচন্দ্র পরিচালিত ১৯৩৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পরাজয়’ ছবিতেও শোনা গেল রবীন্দ্র সঙ্গীত। সেখানেও কানন কণ্ঠ, কাননের লিপ। এ-ছবির ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
তারপর ১৯৪১ সালে নীতিন বসু পরিচালিত ছবি ‘পরিচয়’-এও কানন নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করলেন। এই ছবিতে কানন ও সায়গলের কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। তার মধ্যে কাননের গাওয়া ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে’ ও ‘আমার বেলা যে যায়’ গান দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে, এই দুটি গানই সর্বপ্রথম কানন দেবীর কণ্ঠেই রেকর্ডে স্থান পায়। সুতরাং, রবীন্দ্র সঙ্গীত ও রেকর্ডের ইতিহাসে একে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলা যায়।
রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন এমনি করেই কাননের কণ্ঠে রইলেন, মননে রইলেন, প্রেরণায় রইলেন, সান্ত্বনায় রইলেন, স্বদেশে রইলেন; রইলেন বিদেশেও। সেই ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে কানন যখন বিলেতে গেছেন সেখানকার চলচ্চিত্রের কলাকৃতি নিজের চোখে দেখে আসতে, তখন ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়ে গেল। সেই দিনই ইন্ডিয়া হাউস তাঁকে ডেকে এ-দিন সেখানে সংবর্ধনা দিল। তখন কানন গাইলেন গান। রবীন্দ্র নাথের গান—‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’। বিদেশের মাটিতে সে-দিন বাংলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েই তিনি নবীন স্বাধীনতাকে বরণ করেছিলেন। এও এক ইতিহাস…