আলোয় ছায়ায় কামিনী উপাখ্যান

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”

 

তাঁর কবিতার পংক্তি একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত। পরবর্তী সময়ে পাঠ্য বইতেও সংকলিত হয়েছিল। প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘আলো ছায়া’। এই গ্রন্থে সংকলিত কবিতা মাত্র ষোল বছর বয়সে লিখেছিলেন তিনি। প্রথম প্রকাশ ১৮৯৯। অষ্টম প্রকাশ ১৯২৫। কবি হেমচন্দ্র ‘আলো ছায়া’ পাঠ করে লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালা ভাষায় আমি এইরূপ কবিতা অতি অল্পই পাঠ করিয়াছি। ......’

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। কামিনী রায়।

জন্ম অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে। ১৮৬৪-র ১২ অক্টোবর। বাবা বিখ্যাত লেখক চণ্ডীচরণ রায়। জলপাইগুড়ির মুন্সেফ।   

 শিক্ষা জীবনের শুরুটা বাবার কাছে। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত বাবার লাইব্রেরিতে। সেই আবহাওয়াতেই কামিনীর বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকে অঙ্কে আগ্রহ এবং পারদর্শীতা ছিল। মেধা দেখে শিক্ষক শ্যামাচরণ বসু তাঁকে 'লীলাবতী নামে ডাকতেন।

ব্রাহ্ম পরিবারের খোলা হাওয়া জ্ঞান এবং মেধা চর্চার জন্য সমস্ত জানলা খুলে দিয়েছিল তাঁর জন্য।

১৮৮০ তে বেথুন কলেজে থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৮৮৬ তে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে সংস্কৃত ভাষায় স্নাতক হন। সাফল্যের পথ খুব সহজ ছিল না। অনেকগুলো দেওয়াল ভেঙে তবে তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন নিজের চলার রাস্তা। সেসময় মেয়েদের পড়াশোনার প্রচলন ছিল না। লিঙ্গ বৈষম্য তুঙ্গে। অন্দরে পর্দাসীনা মেয়েরা যে প্রকাশ্যে এসে স্কুল, কলেজ, বিশ্ব বিদ্যালয়ে পাঠ নিতে পারে তা ছিল ভাবনার বাইরে। মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে নাটক-নভেল পড়ে ‘সংসার রসাতলে’ পাঠাবে এ ছিল প্রচলিত ধারণা।

 শুধু সিরিয়াস ছাত্রী হিসেবেই নয়, সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কেও ছিলেন গভীর ভাবে সচেতন। কলেজে থাকতেই পরাধীন দেশের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় অ্যালবার্ট আইনের বিরোধীতা করেছিলেন প্রকাশ্যে।  পরে বেথুন স্কুলেই শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন।

সমস্ত ক্ষেত্রেই তিনি ব্যতিক্রমী। বিবাহের ক্ষেত্রেও সেই ধারা অব্যাহত।

কামিনী রায়ের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন এক নব্য যুবক। সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়। বিবাহ করেন। কামিনীর বয়স তখন তিরিশের কোঠায়।  উনিশ শতকের গোঁড়া রক্ষণশীল ভারতীয় সমাজ যা ভাবতেই পারত না। তখনও দুর্লভ নয় বাল্য বিবাহ, গৌরিদান। কুড়ি পেরিয়েও কন্যার পাণি গ্রহণ সম্পন্ন করতে না পারলে বাংলার গ্রামগুলিতে একঘরে হতে হত পরিবারকে। এহেন প্রেক্ষাপটে কামিনীর বিবাহ নিঃসন্দেহে বিপ্লব বলা  যায়।   

মৃত্যু, শোকের ধাক্কা বারবার তছনছ করেছে তাঁকে। একের পর এক মৃত্যু সয়েছেন। ১৯০০ সালে সন্তানের মৃত্যু। ১৯০৮ সালে ফিটন দুর্ঘটনায় আকস্মিকভাবে হারালেন স্বামীকে। ১৯২০ তে পুত্র ও কন্যার অকালমৃত্যু। উথালপাতাল জীবন। অসহ্য শোকের দহনে পুড়েছেন।

সন্তানহারা মায়ের শূন্যতা শব্দমালার কাছে ঋণী হয়ে উঠল পূর্ণতার সন্ধানে।  বিবাহের পর সংসারের কর্তব্যের বেড়িতে বাধা পড়ে থেমে গিয়েছিল লেখা। শোকের পাথার ভেদ করে তাই যেন ফিরে এল প্রথম সূর্যের আলোয়। তিনি আশ্রয় নিলেন কবিতায়। প্রিয় পুত্রের স্মৃতিতে লিখলেন ‘ অশোক সঙ্গীত’।

বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন। কিন্তু কবি হিসেবেই মূলত তাঁর খ্যাতি।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুর সংস্পর্শে এসেছিলেন। মেয়েদের সমস্যা, তাঁদের দিন যাপনের লড়াই, জীবন সংগ্রাম উঠে আসত তাঁর ভাষায়। অন্দর মহলের দমচাপা চিৎকার শরীর পেত তাঁর লেখনীতে। নারীর স্বাধিকার নিয়ে কণ্ঠ তুলেছেন বারবার মহিলা শ্রমিক তদন্ত কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। কুমুদিনী মিত্র আর মৃণালিনী সেনের সঙ্গে ১৯২১- এ নারী সমাজ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন।  এক সময় লিখেছিলেন,

রমণীর তরে কাঁদে না রমণী,
লাজে অপমানে জ্বলে না হিয়া?
রমণী শকতি অসুরদলনী ,
তোরা নিরমিত কি ধাতু দিয়া?”

 

কামিনী রায় ছিলেন রবীন্দ্র সমকালীন কবি। বঙ্গীয় সাহ্যত্য পরিষদের সহ-সভাপতি পদে ছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২৯ সালে তাকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক'-এ সম্মানিত করে।  

বাংলা ভাষার মহিলা কবিদের মধ্যে আজও তিনি বিশিষ্ট আসনে। কবিতার বলিষ্ঠ ভাষায় এবং দর্শনে তিনি নিজের সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিলেন। শব্দে মিশেছিল মানুষের ঘাম, রক্ত, বেদনার কথা। সেই অনুভবই কামিনী রায়ের কবিতাকে কালত্তীর্ন করেছে।

জীবনের উপপ্রান্তে তিনি হাজারিবাগে বাস শুরু করেন। সেখানেই কাটে শেষ জীবন। ১৯৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর, সেখানেই ফুরিয়ে যায় কামিনী উপাখ্যান।  

      

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...