তিনি ছিলেন দুর্দমনীয়, ছিলেন স্বাধীনচেতা। উত্তরঔপনিবেশিক কালের অন্যতম দৃঢ় নারীবাদী কন্ঠ ছিলেন শিল্পী কমলা দাস। ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষা মালয়লমেও সারাজীবন লিখে গিয়েছেন আত্মপন্যাস। মালয়লম পাঠকদের কাছে ‘মাধবী কুট্টি’ এবং ইংরেজি পাঠকদের কাছে ‘কমলা দাস’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। লেখায় স্বীকারক্তি শৈলীর উপস্থিতি থাকায় সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা হয়। আমাদের দেশের ইংরেজি কবিতায় অনস্বীকার্য অবদান থাকায় ‘আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি কবিতার জননী’র তকমা অর্জন করেছিলেন কমলা।
১৯৩৪ সালের ৩১শে মার্চ কেরালায় জন্মগ্রহণ করেন ঊনিশ শতকের এই কবি। শৈশবের একাংশ কেটেছিল পৈতৃক ভিটে, কেরালার মালাবারে। বাবা কর্মসূত্রে কোলকাতা পাড়ি দিলে, শৈশবের আরেক অংশ কাটে সেখানে। তাঁর শিল্পবিদ্যা তথা নন্দনচর্চায় সমৃদ্ধ পরিবারকে সাহিত্যের রাজপদাধিকারী রূপে সবাই চিনতেন। মা বলমণি আম্মা ছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় কবি। দাদু নলপত নারায়ণ মেনন ছিলেন সে কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। আত্মজীবনীতে শৈশবচারণ করতে গিয়ে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘শৈশব ছিল সাংস্কৃতিক মাধুর্য্যে ঘেরা।“
বাড়ির বড়দের দেখাদেখি ছোটো থেকেই লেখালেখির প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করতেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে একটি পান্ডুলিপি পত্রিকা লিখতে শুরু করেন। সেখানে মুলত তিনি মুন্ডুহীন পুতুলদের নিয়ে দুঃখের কবিতা লিখতেন, যাদের অনন্তকাল মুন্ডুহীন থাকতে হবে। কবিতাগুলির ইলাস্ট্রেশনে সাহায্য করে দিতেন ভাই। আরও একটু বড় হলে, ভাইয়ের সাথে কমলাকে একটি শিশুদের থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি নিয়মিত ক্লাস করতেন। ভিক্তর উগো’র লা মিজারেবল্ থেকে কালিদাসের শকুন্তলা, সমস্তই মঞ্চস্থ করে ফেলেছিলেন সেই বয়সে। তাদের পৈতৃক বাড়ির বহিরাঙ্গনে মঞ্চটি স্থাপন করা হলে সমস্ত গ্রামবাসীদের জন্য ছিল তা ছিল নাটক দেখার উন্মুক্ত ক্ষেত্রপরিসর।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্মচারী মাধব দাসের সাথে বিয়ের পর স্বামীর সাথে মুম্বই পাড়ি দেন কমলা। স্বামী, পরিবার ও সমাজের একাংশের তরফ থেকে পরিপূর্ণ ‘মা’ ও ‘স্ত্রী’ হয়ে ওঠার কর্তব্য ও প্রত্যাশার বোঝার চাপে ব্যক্তিগত লেখালেখির পরিসর অন্বেষণ করতে যথারীতি বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। উচ্চ বংশ পরম্পরা ছাড়া সে সময়ের মহিলা লেখকদের তেমন স্বাধীনতা ছিল না। তারমধ্যে সে সময় তাঁর বয়সও ছিল অত্যন্ত কম।
সে সময় লেখালেখি নিয়ে মহিলাদের প্রতিবন্ধকতা সম্বন্ধে আত্মজীবনের একটি অংশে তিনি লেখেন, “অন্য কিছু হওয়ার আগে একজন নারীকে প্রথমে ভালো মা ও ভালো স্ত্রী হয়ে উঠতে হয়। আর তার অর্থ হল বছরের পর বছর অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়স অবধি অপেক্ষা করে যাওয়া। আমি অধৈর্য্য ছিলাম, সুতরাং খুব অল্প বয়সেই আমি লেখালেখির সান্নিধ্যে আসি। এবং সম্ভবত সে ক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবতী ছিলাম। লেখালেখি মারফত পরিবারে অর্থ সংযোজনের ব্যাপারটিকে সমর্থন করেছিলেন আমার স্বামী। তিনি আমাকে রাত্রে লেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। সংসারের সমস্ত পাঠ সম্পন্ন হলে, বাচ্চাদের এবং তাঁকে খাওয়ানোর পর, আমি রান্নাঘর পরিষ্কার করতাম। একা বসে ভোর পর্যন্ত লিখে যাওয়ার ব্যাপারে আমাকে অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল, যার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল আমার স্বাস্থ্যে।“
সংসার, সমাজ ও পরিবারের রক্ষণশীল চাপে অনেক মহিলাই তাঁদের ইচ্ছে থেকে বিচ্যুত হয়ে চাপিয়ে দেওয়া জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। তাঁর কবিতাগুলি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব কিভাবে তিনি কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁর পরের প্রজন্মের নারীদের, নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন করে গেছেন। তাঁর কবিতায় তিনি নারীদের, পুরুষদের মতোই আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণাপূর্ণ মানুষ হিসেবে বর্ননা করেছেন।
‘এক বিধবার শোকসঙ্গীত’ শীর্ষক একটি কবিতায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে তিনি পুরুষশাসিত পৃথিবীতে বন্দী হয়ে পড়েছেন, আর তা হয়েছে এমনভাবেই যে তিনি আর এই পৃথিবীকে নিজের বলে মনে করতে পারছেন না।
‘এটা সবসময়ই ছিল
অন্য কারোর পৃথিবী আমার নয়
আমার ছেলে ও আমার মানুষটা একটা বৃত্ত আঁকছে
যেখানে আমি, স্ত্রী ও মা
তাদের চোখের তৈরী কাঁচের শার্সিতে উঠে চলেছি’
১৯৭৩ সালে কমলা’র আত্মজীবনী ‘আমার গল্প’ তাঁর নিজের ভাষা মালয়লমে প্রকাশিত হয়। ১৫ বছর পর সেই পান্ডুলিপিতে আরও কিছু লেখা সংযুক্ত করে ‘মাই স্টরি’ নামে তা ইংরেজিতে অনুদিত হয়। বস্তুত গ্রন্থটি ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দাঁড়িয়ে একটি নারীর ব্যক্তিগত ও পেশাগত অভিজ্ঞতার জীবনালেখ্য।
মেন্সট্রুয়েশন, বয়ঃসন্ধি, প্রেম, রিরংসা, বাল্য বিবাহ, সমকাম, নাস্তিকতা ও যৌনতার মতো বিষয়গুলি ছিল তাঁর লেখনীর মৌলিক অঙ্গ। এই বিষয়গুলির উপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি হয়েছে তাঁর প্রাত্যহিক জর্নাল। অর্থাৎ সমাজের ঠিক করে দেওয়া নিষিদ্ধ বিষয়গুলিই অবধারিতভাবে উঠে আসতো তাঁর কলমে। আর তাঁর প্রভাব ছিল এতই, যে দীর্ঘদিন এই পান্ডুলিপি প্রকাশ করেনি কেরালা সোসাইটি। পরে তা প্রকাশ হলে, তাঁর প্রভাবও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তুমুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, এমনকি গ্রন্থটিকে ভারতীয় আত্মজীবনীর জঁরে অন্যতম ‘ক্লাসিক কাল্ট’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জীবনে যা যা ঘটেছে, সেই সমস্ত ঘটনার শৈল্পিক ও মূর্ত চিত্রায়নকেই তিনি কন্টেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁকে সততার সাথে শব্দের মাধ্যমে উপস্থিত করাই ছিল তাঁর শৈলীর প্রধান প্রকাশকোণ। প্রত্যেকটি মহান লেখকই সৎ স্বীকারোক্তিকে লেখনীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বেছে নেন, কারণ প্রতিটি লহমায় টেক্সট স্বয়ং তাঁর কাছে কৈফিয়ত প্রত্যাশা করে। তাই ভাষা প্রকাশের জন্য এই নির্বিকল্প জমি, জার্নাল ছাড়া বোধ হয় অন্য কোনো ফর্মে নেই। বিনয়ের কবিতা যেমন, পয়ার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সৃষ্টি করে গেছেন ওমনিপ্রেজেন্ট কবিতার জর্নাল। জেনের আত্মজীবনী ‘তস্করের দিনলিপি’ বা ‘চোরের জর্নাল’ ফ্রান্সে প্রকাশিত হলে, সাঁত্রে স্বয়ং পাঁচশো পাতা ব্যয় করেছিলেন ‘সেইন্ট জেনে’ লিখতে গিয়ে। জীবনানন্দীয় ডিসকোর্সে উঁকি দিলে অবধারিত ভাবে ‘মাল্যবান’কে বেছে নিতে হবে আত্মজীবনী হিসেবে। তিনি আবার দিনলিপি লিখেছেন উপন্যাসের ফর্মে।
আত্মজীবনী ছাড়াও কমলার হাত থেকে রচিত হয়েছে উপন্যাস ও ছোটো গল্প। ১৯৭৩-এ কমলা’র বেশ কিছু ইংরেজি কবিতা একত্রিত করে এক মলাটে ‘সামার ইন ক্যালকাটা’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে ইংরেজিতে ‘অ্যালফাবেট অফ লাস্ট’ (রিরংসার বর্ণমালা) উপন্যাস ও ১৯৯২ সালে ‘পদ্মাবতী দ্য হার্লট অ্যান্ড দ্য আদার স্টরিজ’ (পতিতা পদ্মাবতী ও অন্যান্য গল্প) শীর্ষক একটি ছোটো গল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়। নিজের ভাষা মালয়লমে ‘বাল্যকলাস্মরণকাল’ (ছেলেবেলার স্মৃতি) ও চন্দনামরঙ্গল (চন্দন গাছ) ও অন্যান্য গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়।
সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান থাকায় সমগ্র জীবনে বিবিধ পুরষ্কার অর্জন করেছেন কমলা। তাঁর অপার ও বাঙ্ময় স্বীকারোক্তিপূর্ণ রচনা বারবার পাঠক মননকে স্রোতস্বিনী জলধারা রূপে অতল সাগরে প্রবেশ করিয়েছে। ১৯৬৩-তে এশিয়ান কবিতা পুরষ্কার, ছোটো গল্প ‘থানুপ্পু’র (ঠান্ডা) জন্য ১৯৬৯ এ কেরালা সাহিত্য আকাদেমী পুরষ্কার, ১৯৮৫ তে জাতীয় সাহিত্য আকাদেমী পুরষ্কারে সন্মানিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৪ তে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের নমিনেশনে তাঁর নাম থাকলেও নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তি হয়নি তাঁর। তাঁর রচনাগুলি জর্মান, ফরাসি সহ আরও বেশ কিছু ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
বিবিধ পুরষ্কারে সমৃদ্ধ হলেও কমলার জীবন ছিল আগাগোড়া বিতর্কিত। অথবা বলা ভালো অনেকটা তাঁর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছিল 'বিতর্ক' শব্দটি। পরবর্তীকালে লেখালেখি’কে চিত্রকলায় রূপান্তরিত করার ফলে অবধারিতভাবেই বিষয়মাফিক ‘ন্যুড’ বা ‘নগ্নতা’ ধরা দেয় তাঁর ব্রাশ স্ট্রোকে। এ নিয়েও কম বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি, আর এই বিতর্ক আরও পাখা গজিয়ে ওঠে যখন তিনি ১৯৯০ এর শেষের দিকে ইসলামে রূপান্তরিত হন।
২০০৯ এর ৩১শে মে, পুনেতে দেহত্যাগ করেন ৭৫ বছর বয়সী শিল্পী কমলা দাস। এরপর তামিল ও মালায়লমে তাঁকে নিয়ে তৈরী হয় বায়োপিক।
বহু বিতর্ক সত্ত্বেও তাঁকে অস্বীকার করার সাধ্য হয়নি কারোর। তথাকথিত সামাজিক ভদ্রতার বিরূদ্ধে বারবার ঝলসে উঠেছে তাঁর লেখজ্যোতির চূড়ান্ত আস্ফালন। সরাসরি কোনো নারীবাদী আন্দোলনে অংশ না নিলেও অনেকাংশেই নিজেকে মনে করতেন নারীবাদী। স্বাধীনতার স্বপক্ষে সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠকদের দেখতে বাধ্য করিয়েছেন এই শিল্পী। একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি আমার ভুলগুলোকে ভুল হিসেবে দেখি না, মানুষের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য রূপে দেখি; এমনকি শক্তি রূপেও।“
আশা করা যায় সময়ের সাথে সাথে তাঁর লেখা আরও দীর্ঘকাল পাঠকমহলে সমাদৃত হবে, পাশাপাশি ভারতে ইংরেজি ও মালয়লম ভাষার সাহিত্যে অনস্বীকার্য অবদান থাকার জন্য চিরকাল তাঁর সৃষ্টিশীল লেখনীর মধ্যে দিয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কমলা দাস।