লাবড়া
লাবড়ার প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনও সংশয় নেই। শ্রীচৈতন্যদেবের অতি প্রিয় এই সবজি বিষয়ে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত-তে আছে-“ সার্ব্বভৌম পরিবেশন করেন অপেনে/ প্রভু কহে দেহ মোরে লাফরা ব্যঞ্জনে”। পূর্ববঙ্গীয় রন্ধশৈলির অসামান্য ফসল এই ব্যঞ্জনটি সেই মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত তার জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রেখেছে। অতীত দিনের এই সুপ্রাচীন ব্যঞ্জনের স্বাদ নিতে গেলে জানতেই হবে তার রন্ধনপ্রণালী ।
কী কী লাগবে
আলু-১৫০গ্রাম
বেগুন-২৫০গ্রাম
শিম-২০০গ্রাম
রাঙা আলু- ২৫০ গ্রাম
মুলো-১৫০ গ্রাম
ফুলকপি-২টো(মাঝারি সাইজের)
কাঁচকলা-৪টে
থোড়-২ টো( মাঝারি মাপের)
পটল-৫০০গ্রাম
মিষ্টি কুমড়ো-৫০০গ্রাম
কাঁঠালের দানা-১৫০গ্রাম
হলুদ গুঁড়ো-২ চা চামচ
জিরে গুঁড়ো-২ চা চামচ
ধনে গুঁড়ো- ৩ চা চামচ
লঙ্কা গুঁড়ো-স্বাদ অনুযায়ী
আদা- ৩০ গ্রাম
পাঁচফোড়ন-১ চা চামচ
শুকনো লঙ্কা-২টো
তেজপাতা-৩টে
কাঁচালঙ্কা-৬টা
নারকেল- ১ টা( ছোট)
সরষের তেল- আন্দাজমতো
ঘি- আন্দাজমতো
এত রকমের তরকারির মধ্যে ঋতু অনুযায়ী ৫/৬ রকমের তরকারি হলেই লাবড়া রান্না করা যায়। তবে মিষ্টি কুমড়ো, বেগুন এবং মুলো না থাকলে লাবড়ার স্বাদ হয় না।
কীভাবে রাঁধতে হবে
তরকারিগুলো ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। নারকেল কুরিয়ে রাখতে হবে। সব সবজি মাঝারি আকারে চৌকো করে কেটে নিতে হবে। কাঁচকলা আর থোড় কেটে হলুদ জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। আদা কিছুটা কুচিয়ে নিতে হবে। বাকিটা বেটে রাখতে হবে। কাঁঠালের দানা ভালো ভাবে ধুয়ে অর্ধেক করে কাটতে হবে। কড়াই গ্যাসে বসিয়ে তেল দিয়ে গরম করে শুকনো লঙ্কা, আদাকুচি, তেজপাতা ও পাঁচফোড়ন ফোড়ন দিতে হবে। ফোড়নের গন্ধ বের হলে সব তরকারিগুলো কড়াইতে দিতে হবে। নুন দিতে হবে। তরকারিগুলো ভাজা ভাজা হলে বেগুন আর কাঁচকলা তুলে রাখতে হবে। এবার হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো , আদাবাটা দিয়ে কষিয়ে, কাঁচালঙ্কা চিরে দিয়ে অল্প জল দিয়ে ঢাকা দিয়ে রান্না করতে হবে। কিছুক্ষণ বাদে ঢাকা তুলে বেগুন, কাঁচকলা ,নারকেলকোরা ও চিনি দিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করে গ্যাস কমিয়ে একটু সময় রাখতে হবে। তারপর আঁচ বাড়িয়ে ঘি ও গরমমশলাগুঁড়ো ছড়ালেই তৈরি হয়ে যাবে লাবড়া।
ভোগের খিচুড়ি
“এপারে যে বাংলাদেশ, ও পারে সেই বাংলা”। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় দুই বাংলাতেই কালীপুজো করা হয়। দেবী দুর্গার আর এক রূপ কালিকা বা কালী। যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একদিকে ভীতি, অন্যদিকে ভক্তি। বাংলায় কালীপুজো প্রবর্তিত হয়েছিল নবদ্বীপের কালীসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের উদ্যোগে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই পুজোকে জনপ্র্রিয় করে তুলেছিলেন। দীপান্বিতা কালীপুজোর ক্ষেত্রে তান্ত্রিক ও অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমত- দুভাবেই পুজোর নিয়ম আছে। তবে পুজো যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন, তাতে বলি দেওয়া হোক বা না হোক, ভোগের ক্ষেত্রে খিচুড়ির প্রচলন কিন্তু প্রায় সর্বত্র। বাড়ির পুজো অথবা মন্দির কিংবা বারোয়ারি মন্ডপ-বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়। কীভাবে রাঁধতে হবে ভোগের খিচুড়ি তা জানানো হল এই লেখায়।
কী কী লাগবে
গোবিন্দভোগ চাল- ২৫০ গ্রাম
সোনামুগ ডাল -২৫০ গ্রাম
চন্দ্রমুখী আলু- ১৫০গ্রাম
ফুলকপি-২ টো
টমেটো- ২টো(বড়)
মটরশুঁটি- ১৫০ গ্রাম
কিশমিশ- ৫০ গ্রাম
কাজুবাদাম-৩০ গ্রাম
কাঁচা লঙ্কা- ৫টা
শুকনো লঙ্কা- ফোড়নের জন্য
গোটা জিরে- ফোড়নের জন্য
আদা-৫০গ্রাম
হলুদ গুঁড়ো-২ চা চামচ
জিরে গুঁড়ো-২ চা চামচ
ধনে গুঁড়ো-২ চা চামচ
লঙ্কা গুঁড়ো-স্বাদ অনুযায়ী
চিনি- ৩ চা চামচ
সর্ষের তেল- আন্দাজমতো
ঘি-১০০ গ্রাম
গরমমশলা-ছোট এলাচ-৪টে
লবঙ্গ-৪টে
দারচিনি- ৪টে(ছোট)
তেজপাতা- ৩টে
গরমমশলা গুঁড়ো-১ চামচ
কীভাবে রাঁধবেন
গোবিন্দভোগ চাল ভালোভাবে ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। এক সসপ্যান জল গরম করে রাখতে হবে। আলু ও ফুলকপি ভালোভাবে ধুয়ে কেটে নিতে হবে। আলু একটু ছোট করে কাটতে হবে। ফুলকপি মাঝারি করে কাটতে হবে। ডাঁটার অংশ ছেঁটে দিতে হবে। গ্যাসে কড়াই বসিয়ে গরম করে সোনামুগ ডাল শুকনো খোলায় ভেজে রাখতে হবে। ডাল লালচে হয়ে এলে ঢেলে রেখে কড়াই ধুয়ে নিয়ে গ্যাসে বসাতে হবে। কড়াইতে সর্ষের তেল দিয়ে গরম করে আলু ও ফুলকপি হালকা ভেজে উঠিয়ে রাখতে হবে। ভাজা ডাল ভালোভাবে ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। আদার অর্ধেকের চেয়ে অল্প কম কুচি করে নিতে হবে। বাকি অংশ বেটে নিতে হবে। কিশমিশ বোঁটা ছাড়িয়ে জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। কাজুবাদাম ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। ভোগের খিচুড়ি ঘি দিয়ে রাঁধলেই ভালো হয়। তবে শারীরিক কারণে বেশি ঘি খাওয়ায় অসুবিধে থাকলে তেল-ঘি মিশিয়ে রান্না করতে হবে। অনেক পরিবারে ভোগের খিচুড়িতে আলু, ফুলকপি ইত্যাদি কোনো তরকারিই দেওয়া হয় না। সে সব পারিবারিক রীতিনীতির বাধ্যবাধকতায় না গিয়েও ভোগের খিচুড়ি রান্না করা যায়। এবার কড়াই পরিষ্কার করে ঘি দিয়ে আবার গ্যাসে বসাতে হবে। ঘি গরম হলে শুকনো লঙ্কা, গরমমশলা থেঁতো, গোটা জিরে আর আদা কুচি ফোড়ন দিতে হবে। একটু পরে জল ঝরানো গোবিন্দভোগ চাল কড়াইতে দিতে হবে। চাল একটু ভেজে নিয়ে জল ঝরানো ডাল দিয়ে নাড়াচাড়া করে ভেজে রাখা আলুগুলো দিতে হবে। চাল,ডাল,আলু বেশ নেড়েচেড়ে তাতে হলুদ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, আদাবাটা, টমেটো কুচি ও নুন দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে গরম করে রাখা জল দিতে হবে। জল খুব বেশি দেওয়া যাবে না। কাঁচা লঙ্কা ভেঙে দিয়ে, চিনি, ফুলকপি, কিশমিশ আর কাজুবাদাম দিয়ে মিশিয়ে ঢেকে দিতে হবে। একটু পরপর ঢাকা তুলে খুন্তি দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দিতে হবে যাতে তলায় লেগে না যায়। জল কমে এলে আবার জল দিতে হবে। কিন্তু একসঙ্গে বেশি জল দেওয়া যাবে না। গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগ ডাল সেদ্ধ হতে বেশি সময় লাগে না। আলু ছোট করে কেটে ভেজে নিলে তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়ে যাবে। এই খিচুড়ি খুব পাতলা হবে না আবার খুব ঝরঝরেও হবে না। নামানোর সময় ঘি ও গরমমশলাগুঁড়ো ছড়িয়ে ঢেকে রাখলেই তৈরি হয়ে যাবে ভোগের খিচুড়ি।
নিরামিষ পাঁঠার মাংস
নিরামিষ পাঁঠার মাংস বললে কেমন যেন সোনার পাথরবাটি মনে হয়। পাঁঠার মাংস সে আবার নিরামিষ কী করে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জেনে রাখা প্রয়োজন যে ভারতে প্রধানত পূর্ব ভারতের নানা অঞ্চলে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রাণী উৎসর্গের রীতি আছে। বলির পশুকে রান্না করার কিছু নির্দিষ্ট নিয়মও আছে। সেই রীতি মেনেই গড়ে উঠেছে নিরামিষ অর্থাৎ পেঁয়াজ রসুন ছাড়া পাঁঠার মাংস রান্নার এক ব্যতিক্রমী ধারা। ভারতীয় রান্নায় যা এক আশ্চর্য সংযোজন। দেখা যাক কীভাবে রাঁধতে হবে সেই মাংস।
কী কী লাগবে
পাঁঠার মাংস-১ কেজি
আলু-৩৫০গ্রাম
টমেটো- ৩ টে(বড়)
টক দই- ৫০ গ্রাম
হলুদ গুঁড়ো-৪ চা চামচ
জিরে গুঁড়ো- ৩ চা চামচ
ধনে গুঁড়ো- ৫ চা চামচ
গোলমরিচ গুঁড়ো- ১ চা চামচ
আদা- ৫০ গ্রাম
কাঁচালঙ্কা- ৩০ গ্রাম
দারচিনি, ছোট এলাচ ও লবঙ্গ- সব ৫টা করে।
পিপুল-২৫ গ্রাম
তেজপাতা-৬টা
সর্ষের তেল- আন্দাজমতো
নুন- স্বাদমতো
চিনি- স্বাদ অনুযায়ী
ঘি- ১০০ গ্রাম
কীভাবে রাঁধতে হবে
মাংস পরিষ্কার করে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। আলু ভালো ভাবে ধুয়ে অর্ধেক টুকরো করে নিতে হবে। আদা কিছুটা কুচি করে নিয়ে বাকিটা বেটে নিতে হবে। কাঁচালঙ্কা ৩/৪ টে সরিয়ে রেখে বাকিটা বেটে নিতে হবে। পিপুল আর গরমমশলা(সব ৪টে করে) বেটে রাখতে হবে। মাংস টক দই, হলুদ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, গোলমরিচ গুঁড়ো, আদাবাটা আর অল্প সর্ষের তেল দিয়ে মেখে রাখতে হবে। একটা ডেকচিতে জল গরম করে রাখতে হবে।গ্যাসে কড়াই বসিয়ে সর্ষের তেল গরম করে আলুগুলো ভেজে নিতে হবে। তারপর তেলের সঙ্গে ঘি মিশিয়ে আদাকুচি, গোটা গরমমশলা, তেজপাতা আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিতে হবে। ফোড়নের গন্ধ বের হলে মশলা মাখা মাংস ঢেলে দিতে হবে। টমেটো গ্রেটারে ঘষে নিয়ে মাংসে দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে হবে। মাংসের জল শুকিয়ে গেলে গরম জল অল্প করে দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে হবে। নুন, চিনি আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে নেড়েচেড়ে আন্দাজমতো জল দিয়ে প্রেশারকুকারে ঢেলে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। ৩টে সিটি পড়লে গ্যাস বন্ধ করে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পরে ঢাকনা খুলে আলুগুলো দিয়ে আবার প্রয়োজনমতো সিটি দিয়ে মাংস তৈরি করতে হবে। মাংস সেদ্ধ হয়ে গেলে বাকি গরমমশলাবাটা, পিপুলবাটা আর ঘি মাংসে দিয়ে মিশিয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যাবে বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবন নিরামিষ পাঁঠার মাংস।