কালী কথা: বুনো কালী মন্দির

বঙ্গে ডাকাত আর কালী সমার্থক। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব ডাকাত এবং তাদের আরাধ্যা কালী নিয়ে কাহিনী ছড়াছড়ি আমাদের বাংলায়। বঙ্কিমবাবুর কালাদিঘির গল্পে হোক বা রবি ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতার দৌলতে 'হা রে রে রে ডাকাত এলো তেড়ে'র সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। ডাকাতের কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নৃশংসতা। ডাকাত কালীর কথা বললে, স্বাভাবিকভাবেই নরবলির প্রসঙ্গও চলেই আসে। শাক্ত উপাসনায় যে এককালে নরবলির প্রথা ছিল এ কথা সকলেরই জানা। ডাকাতরাও ডাকাতি করতে বেরোনোর আগে নরবলি দিত বলে শোনা যায়। উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে বেশ কিছু সংবাদপত্রে নরবলির উল্লেখ পাওয়া যায় আছে। ১৮৩৪ থেকে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বিভিন্ন সময়ে হুগলি জেলায় নরবলির সংবাদ পাওয়া যেত।

১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জুলাই তারিখের সমাচার-দর্পনে প্রকাশিত একটি সংবাদে হুগলি জেলার একটি নরবলির বর্ণনা করা হয়–"কিয়দ্দিবস হইল জেলা হুগলির অন্তর্বর্ত্তি কালীপুর গ্রামে এক সিদ্ধেশরী আছেন তাঁহাকে পূজা করিয়া একদিবস পূজারিরা দ্বারবদ্ধ করণান্তর গমন করিয়াছিল পরদিবস তথায় আসিয়া ঐ পূজারিরা দেখিলেক যে কতকগুলিন ছাগ ও এক মহিষ ও এক নর ঐ সিদ্ধেশরীর সম্মুখে ছেদিত হইয়া পড়িয়া আছে ইহাতে তাহারা অনুমান করিলেক যে পূর্ব রজনীতে কেহ পূজা দিয়া থাকিবেক, ইহাতে পূজারিরা নরবলী দেখিয়া রিপোর্ট করাতে তত্রস্থ রাজপুরুষ অস্ত্রশস্ত্রাদি সম্বলিত বহুলোক সমভিব্যহারে তথায় আসিয়া অনেক সন্ধান করিলেন কিন্তু তথায় কিছু অবধারিত হয় নাই আমরা অনুমান করি যে দস্যুরদিগের কর্ত্তৃক এরূপ কর্ম্ম হইয়া থাকিবেক।"

হুগলিতে এরকম বেশ কিছু ডাকাত কালী মন্দির রয়েছে যেখানে কখনও না কখনও নরবলি হত বলে শোনা যায়। ​আবার তারা পীড়িতদের উপকারও করে। ধনীর সম্পদ লুঠ করে দুর্বলদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এই ডাকাতেরাই কালী পুজো করে ডাকাতি করতে বের হত। এক একজন ডাকাতের এক একটি করে কালী থাকত। পরবর্তীতে সেই কালীরাই জনপ্রিয় হয়ে ডাকাতের নামে, আজও তারা পূজিত হচ্ছেন। কিংবদন্তিতে পরিণত হয় সে ডাকাত ও তার কালী আরাধনার গল্প। এমনই এক গল্প আজ বলব। কালী কথায় আজ আমাদের গঙ্গাপাড়ের জেলা হুগলিতে যেতে হবে।

হুগলির এক জঙ্গলাকীর্ণ গঙ্গা-তীরবর্তী দ্বীপ বা দহের নাম ডুমুরদহ। এখানে রয়েছে একটি অতি প্রাচীন কালী মন্দির যা বুনো কালী মন্দির নামেই পরিচিত। পিরামিড আকৃতি চারচালাযুক্ত একতলা সাদামাটা মন্দিরটির স্থাপত্যে আধুনিক কালের নির্মাণরীতির স্মৃতিচিহ্ন স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। সামনেই রয়েছে বাঁধানো চাতাল। বাইরে রয়েছে তোরণ প্রবেশদ্বার। এককালে এই মন্দিরে বলির প্রচলন ছিল, তবে বর্তমানে এখানে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। তাই নিত্য বলি দেওয়ার রেওয়াজ আজ আর দেখা যায় না। তবে কারোর কোন মানত পূরণ হলে, ছাগলের কান কেটে বেলপাতায় করে কালীকে নিবেদন করার রীতির প্রচলন রয়েছে। এই মন্দিরের দেবী কালিকার নাম বুনো কালী হলেও, এই মন্দিরের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ডাকাতদের গল্প। বুনো কালী মায়ের মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ডুমুরদহের কুখ্যাত ডাকাত বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ওরফে বিশে ডাকাতের নাম।

 

buno1

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন বাংলার ডাকাতদের সামলাতে ব্রিটিশ সরকারের হিমশিম অবস্থা, তখন ডুমুরদহের বিশে ডাকাত দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। ডুমুরদহের বিশে ডাকাত ছিল ইংরেজদের ত্রাস। দুর্গাচরণ রায় তাঁর 'দেবগণের মর্ত্যে আগমন' বইয়ে বিশে ডাকাত ওরফে বিশ্বনাথ বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখেছেন-" প্রায় ৬০ বৎসর অতীত হইল বিখ্যাত ডাকাত বিশ্বনাথবাবু এখানে বাস করিতেন। ইহার অধীনে ডাকাইতেরা নৌকাযোগে যশোহর পর্যন্ত্য ডাকাতি করিয়ে বেড়াইত। ডুমুরদহ অঞ্চলে গঙ্গার ধরে তার এক প্রকান্ড বাড়ি ছিল, যেখান থেকে নদীর বহুদূর অবধি নজর রাখা সম্ভব হত।"

হুগলির ডাকাতদের সঙ্গে কালীর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ডাকাতরা দিনের বেলায় নিজেদের স্বাভাবিক পেশায় যুক্ত থাকত আর রাতের অন্ধকারে তারা সিদ্ধেশ্বরী কালীর কাছে কার্যসিদ্ধির আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়ে পড়ত ডাকাতির উদ্দেশ্যে। কখনও ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতে বা পণ্যবাহী নৌকায়, কখনও বা নীলকুঠিতে তারা লুঠপাট চালাত। কেউ কেউ নাকি অতিরিক্ত ধন-সম্পত্তি গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিত বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে ডাকাত ও ডাকাত কালী নিয়ে বিশেষ কৌতূহল। হুগলীর ডাকাতরা মূলত জলপথে যাতায়াত করত বলেই হয়তো হুগলী নদীর তীরবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাগুলোই ছিল তাদের গোপন আস্তানা, আর এই সব অঞ্চলেই তৈরি হয়েছিল ডাকাত কালীর মন্দিরগুলো।

আজ বিশে ডাকাতের বাড়িও নেই, আর সেই ডাকাতরাও নেই। দস্যু দল কিছুই নেই, কিন্তু স্থানীয় মানুষের স্মৃতিতে আজও রয়ে গেছে সেই সব ডাকাতদের গল্প। শোনা যায় রত্নেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই ডুমুরদহের জমিদার বংশের আদি পুরুষ। সুবে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের আমলে কোন এক ষড়যন্ত্র থেকে নবাবকে উদ্ধার করার সুবাদে, তিনি নবাবের কাছে থেকে রায় উপাধি পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গেই রত্নেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান, কাটোয়াসহ সাতটি অঞ্চলের জমিদারির অধিকার লাভ করেন। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তীকালে এই রায়-বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের উত্তর পুরুষরেই ডাকাতির পেশায় জড়িয়ে পরেন বলেই, প্রচলিত ইতিহাস থেকে জানা যায়। তারা যখন ডাকাতি করতে যেতেন, তার আগে এই কালী মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়ে যেতেন। সেই মন্দিরই আজকের বুনো কালী মন্দির। বিশে ডাকাতের আরাধ্যা দেবী আজও পূজিত হয়ে আসছেন।

ডুমুরদহের বুনো কালী মাতার মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি চারচালা ভৈরব মন্দির। মন্দিরটির টেরাকোটার কাজ লক্ষণীয়, খাওয়প্রাপ্ত হলেও এটি আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। বাংলার ইতিহাস, কিংবদন্তি গল্পগাঁথা, শিল্পকলা, স্থাপত্য এবং প্রাচীনত্বের অনন্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...