কালীঘাট কলকাতার শ্রেষ্ঠ কালীক্ষেত্র

কলকাতার অন্যতম সেরা কালীক্ষেত্র কালীঘাট। এখানকার দেবতা কালী ও পীঠ রক্ষক ভৈরব নকুলেশ্বর। সতী স্নেহবশত শিবলিঙ্গরূপ ধারণ করে কালীঘাটে নকুলেশ্বর নামে বিরাজ করছেন এবং ব্রহ্মা এখানে একটি কালীমূর্তি স্থাপন করেন। কালীক্ষেত্র কালীঘাটে সতীর দক্ষিণ পদের চারটি আঙুল পড়েছিল। তাই একান্নটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠের মধ্যে কালীতীর্থ কালীঘাট একচল্লিশতম সতীপীঠ।

দক্ষিণেশ্বর থেকে বহুলা(কালীঘাটের দক্ষিণবর্তী রাজপুরের কিছু দক্ষিণ পূর্ব আকনা গ্রামের সন্নিকট স্থান বোলপুর নামে খ্যাত)পর্যন্ত দু-যোজন অর্থাৎ আট ক্রোশব্যাপী এলাকাই কালীক্ষেত্র। এর মধ্যে একক্রোশ পরিমিত ত্রিকোণাকার ক্ষেত্রের মধ্যে কালিকাদেবী বিরাজমানা। যেখানে নকুলেশ ভৈরব এবং গঙ্গা বিরাজ করেন সেই স্থান মহাপুণ্যক্ষেত্র। কাশীক্ষেত্র ও কালীক্ষেত্র উভয়ের মধ্যে কোন ভেদ নেই। এই মহাপুণ্যস্থানে ভৈরবী,বগলা, মাতঙ্গী, কমলা, ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী ও চণ্ডী এই সনাতনী অষ্টশক্তি অবস্থান করেন। যে জায়গাটিকে এখন কালীঘাট বলা হয়, বিশেষ কোনও প্রাচীন নাম না থাকলেও তা যে পুরাণের "সমতট" প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল তার সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে ইউরোপীয় ভূতত্ববিদ পণ্ডিতেরা দক্ষিণ বাংলার রসাতল প্রবেশের বিষয়ে প্রমাণ দিয়েছেন। তাদের মতে কলকাতি ও তার কাছে জায়গাগুলি ক্রমশ নীচের দিকে এগিয়ে গেছে। এইসব প্রাচীন ক্ষেত্রগুলি ওপর দিক থেকে অনেকটাই বসে গেছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, যে জায়গাটি এখন কালীঘাট হিসাবে চিহ্নিত করা আছে, তার অনেক নীচের জমিতে অনেকদিন আগে মানুষেরা বসবাস করতেন। ক্রমশ রসাতলে চলে যাওয়ায় জায়গাটি মানবশূন্য হয়ে যায়। ফলে এই জায়গাটি আবার মানুষের বাসযোগ্য হওয়ার সময় লাগে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর বহু তীর্থ বিষয়ক গ্রন্থে কালীঘাটের নামোল্লেখ করে দেবী কালিকার উদ্দ্যেশ্যে প্রণাম নিবেদন করা হয়েছে। কিছু কিছু তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় কালীঘাট বা কালীঘট্ট বা কালীক্ষেত্র বল্লাল সেন যুগেরও প্রাচীন।

তীর্থ কালীঘাটের মন্দির সৃষ্টি ও মূর্তি স্থাপনের ব্যাপারে বাংলার প্রাচীন জমিদার বংশীয় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আশ্বিন মাসের লক্ষ্মীপুজোর দিন, ৯৭৭ বঙ্গাব্দের(১৫৭০সাল) এই দিন অপরাহ্ন ৪টে বেজে ১৫ মিনিটে লক্ষ্মীকান্তের জন্ম হয়। লক্ষ্মীপূর্ণিমার দিন জন্ম বলে তাঁর নাম লক্ষ্মীনারায়ণ বা লক্ষ্মীকান্ত। লক্ষ্মীকান্তের জন্মের আগে কামদেব ওরফে জীয়া গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতীদেবীর সন্তান না হওয়ায় আত্মীয়-স্বজনগন বললেন, কালীঘাটে গিয়ে তাদের পারিবারিক দেবতা দেবী কালিকার কাছে পুত্রকামনায় তিনদিন তিনরাত্রি ধরে সাধনার জন্য। তৃতীয়দিন রাত্রিকালে কালীমন্দিরের পুষ্করিণীর জলের ওপর এক আলোর ছটা দেখতে পান পদ্মাবতীদেবী। পরদিন ওই পুকুরে স্নান করতে গিয়ে তিনি জলের তলায় সতীর দেহাংশ দেখতে পান ও দৈববাণী শ্রবণ করেন। সেই দৈববাণী শুনে দেবীর প্রধান পুরোহিত আত্মারাম ঠাকুর পুকুরের তলা থেকে দেবীর সতীঅংশের উদ্ধার করেন। ১৫৭০সালে আষাঢ় মাস স্নান পূর্নিমা তিথিতে একটি লাল পট্টবস্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেন দেবী কালিকা। শুরু হল সতীর নিত্য পূজাপাঠ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৫৬৯ সালে হালিশহর থেকে সাবর্ণ গোত্রীয় দম্পতি যখন কালীঘাটে এলেন তখন কালীঘাটের প্রধান পুরোহিত ধ্যানমগ্ন মহাযোগী শ্রীমৎ আত্মারাম ঠাকুরের থেকে তন্ত্রমতে দীক্ষা নিলেন জীয়া গঙ্গোপাধ্যায় এবং পদ্মাবতীদেবী। 

প্রসঙ্গত লক্ষ্মীকান্তের জন্মের পর তার মা পদ্মাবতীদেবী মারা গেলেন। লক্ষ্মীকান্তকে কালীঘাটে রেখে কামদেব বেরিয়ে পড়লেন। শেষে তিনি কাশীতে ছিলেন ও কামদেব ব্রক্ষ্মচারী রূপে ভারত বিখ্যাত সাধকে পরিণত হয়েছিলেন। কামদেবের পুত্র লক্ষ্মীকান্ত বাড়তে থাকেন তাঁর গুরু মহাত্মা আত্মারাম ঠাকুরের কাছে। পাঁচটি আঞ্চলিক ভাষায় শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে উন্নীত হন। বঙ্গে প্রতাপাদিত্যকে দমন করে মানসিংহ লক্ষ্মীকান্তের বিদ্যাবত্তা এবং যশোর তালুকের নায়েব থাকাকালীন প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে তার দক্ষতার বিষয়ে অবগত হলেন। সেই সমস্ত কথা শুনে মানসিংহ কালীঘাটে লক্ষ্মীকান্তের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে বলে যে তার পিতা কামদেবের শিষ্য তিনি(মানসিংহ), পিতার নির্দেশে তিনি তাঁকে(লক্ষ্মীকান্তকে) গুরুদক্ষিণা প্রদান করতে চান। লক্ষ্মীকান্তের ব্যবহার, পাণ্ডিত্য, উপস্থিতবুদ্ধি দেখে অভিভূত হয়ে মানসিংহ তাকে "মজুমদার"পদমর্যাদায় ভূষিত করলেন।

কালীক্ষেত্রের কালীমূর্তির প্রথম আবিষ্কারের বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমান কালীমন্দিরের অনতিদূরে পর্ণকুটীরে কোন ব্রাহ্মণ বানপ্রস্থ অবলম্বনপূর্বক তপস্যা করছিলেন। একদিন সন্ধ্যায় ভাগীরথী সলিলে সন্ধ্যা বন্ধনাদি পাঠ করছেন এমন সময় অনতিদূরে এক আলোকজ্যোতির সন্ধান পান। সেই আলোকজ্যোতি দেখে ব্রাহ্মণের কৌতুহল বৃদ্ধি হল এবং তিনি ওইদিকে(কালীকুণ্ডের) গিয়ে দেখলেন ওই দিব্য আলো নিঃসৃত হয়েছে। পরে কালীর প্রত্যাদেশ মতে জানতে পারলেন যে পূর্বকালে সুদর্শন ছিন্ন হয়ে তাঁরই অঙ্গ ওই স্থানে পতিত হয়েছিল। তখন সেই ব্রাহ্মণ অনুসন্ধান করতে করতে অদূরে স্বয়ম্ভু নকুলেশ্বর রয়েছেন দেখতে পেলেন। এবং তিনি ওই স্থানে উক্ত প্রস্তরবৎ সতীঅঙ্গ যত্নপূর্বক রেখে কালীমূর্তি ও নকুলেশ্বরের পুজো করতে শুরু করেছিলেন।

আবারও অন্যমতে ব্রহ্মানন্দগিরি এবং আত্মারাম ঠাকুর মহামূল্যবান কষ্টিপাথরে দক্ষিণাকালী মাতার রূপদান করেছিলেন সাবর্ণ গোত্রীয় রায় চৌধুরীদের কুলমাতা মা ভুবনেশ্বরীর রূপ দেখে ১৫৭০সালে। ওই শিলার মধ্যেই দেবী-কালিকা আবদ্ধা আছেন। কালীঘাট পুণ্য পীঠস্থানরূপে আত্মপ্রকাশের মূলে রয়েছেন মহাতপস্বী দুই সাধক আত্মারাম ঠাকুর এবং ব্রহ্মানন্দগিরি। আর রয়েছেন কামদেব ও পদ্মাবতীদেবীর সাধনা ও স্বপ্নাদেশ। শিবপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর "প্রাচীন কলিকাতা" বইতে লিখেছেন, পনেরোশ শতাব্দীর শেষভাগে বা ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গোবিন্দপুরে তখনকার কালীঘাটে মা কালীর পূজার্চনা শুরু হয়। এক্ষেত্রে আরও একটি কথা উল্লেখ্য যে সাবর্ণ গোত্রীয় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়(রায়চৌধুরী) মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের থেকে জায়গির প্রাপ্তির পর তিনিই  কালীঘাটের মন্দির তৈরী ও দেবীর সেবার জন্য ব্যবস্থা করে দেন। বলাবাহুল্য যে লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী প্রায় ৫৯৫ বিঘা জমি দান করেছিলেন।

 

শিবপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় আরও উল্লেখ করেছেন, গোবিন্দপুরের পুরনো নাম কালীঘাট এবং বর্তমানে যেখানে জি.পি.ও(জেনারেল পোস্ট অফিস)আছে সেখানেই ছিল মা কালীর মন্দির। প্রমথনাথ মল্লিক তাঁর "কলিকাতার কথা" বইতে(আদিকাণ্ড পৃষ্ঠা ১ ও ২) লিখেছেন, কালীদেবী কবে কলকাতা হইতে কালীঘাটে যান তাহার সবিশেষ তথ্য অবগত হওয়া দুরূহ তবে এই পর্যন্ত শোনা যায় বর্তমান পানপোস্তার উত্তরে দেবীর মন্দির ও পাকা ঘাট ছিল। সেই পুরাতন পাথরে বাঁধান ঘাট হইতে বর্তমান পাথুরিয়াঘাটার নাম হয়েছে যদিও এই মতেরও বিরুদ্ধাচরণ করেছেন ধর্মানন্দ মহাভারতী।

ব্রহ্মানন্দের জন্মের আগে বিপ্রদাস পিপলাইয়ের "মনসাবিজয়"ও সমসাময়িক কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর "চণ্ডীমঙ্গলে" কলিকাতা এবং কালীঘাটের উল্লেখ পাওয়া যায়। এইরূপ প্রবাদ আছে যে বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী গোষ্ঠী বাংলার দক্ষিণ অংশের জমিদারী প্রাপ্ত হয়ে কালীঘাটের কালীমূর্তির আবিষ্কার করেন।

কালীর সেবায়েতগণের মধ্যে ভুবনেশ্বর চক্রবর্তী কুলব্রহ্মচারীর নাম প্রথম পাওয়া যায়। ভুবনেশ্বর যোগ সাধনায় রত থাকতেন এবং পীঠস্থান নির্জন কালীঘাটে গঙ্গাতীরে বাস করে কালীর সেবা করতেন। একদিন এক গরিব বিধবা ব্রাহ্মণী মন্দিরে দেবীদর্শনে আসেন। সঙ্গে অষ্টাদশী অবিবাহিত কন্যা। নাম যোগমায়া। ভুবনেশ্বরগিরি এই কন্যার রূপসৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভৈরবীরূপে গ্রহণ করেন। তন্ত্রে ভৈরবী রাখার নির্দেশ আছে। কিছুদিন পরে যোগমায়া এক কন্যার জন্ম দিলেন। নবজাতা শিশুকন্যার নাম রাখলেন উমা। উমার সঙ্গে খানিয়ান গ্রাম নিবাসী ভবানীদাস চক্রবর্তীর বিবাহ হয়। কারণ ভুবনেশ্বরগিরি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অদ্ভূত দৈববাণী পেলেন-"বৎস,ভুবনেশ্বর এবার উমার বিয়ে দিয়ে আমার পূজা কর। সন্ন্যাসীদের রেহাই দিয়ে সংসারীর হাতে তুলে দে।"

ভুবনেশ্বরগিরির অনুরোধে ভবানীদাস কালীঘাটে থেকে গেলেন। দেবীর পূর্বের আদেশমতোন ভুবনেশ্বরগিরি বৈষ্ণব ভবানীদাসের ওপর দক্ষিণা কালিকার পূজা-আরতির ভার দিলেন। এখন থেকেই শুরু হল গৃহীভক্তের হাতে কালীমাতার পূজার্চনা। সন্ন্যাসী ভুবনেশ্বরগিরিই কালীঘাটের শেষ মোহান্ত। কালীঘাটের বর্তমান মন্দির তৈরী করেন বড়িশার সাবর্ণ গোত্রীয় সন্তোষ রায় চৌধুরী। সন ১২০৯ অর্থাৎ ১৮০২-০৩ সালে দাখিলী ভূমির তায়দাদে দেখা যায় যে ১১৫০ সনের কাছাকাছি অর্থাৎ ১৭৫৭ সালে মনোহর ঘোষাল ও কালীঘাটের তদানীন্তন সেবাইত গোকুলচন্দ্র হালদারকে সন্তোষ রায় চৌধুরী জমীদারীর নানাস্থানে বিস্তর ভূমি দান করেন। ২৪পরগণায় সন্তোষ রায়ে অসীম প্রভুত্ব ছিল। সন্তোষ রায় তদানীন্তন দক্ষিণ প্রদেশের সমাজ অধিপতি ছিলেন। শেষ অবস্থায় সন্তোষ রায় কালীঘাটের কালীর বর্তমান বড় মন্দির নির্মাণ করেন। সন্তোষ রায়ের মৃত্যুর পর প্রায় ৫১৬ বৎসর পরে সাবর্ণ গোত্রীয় রাজীবলোচন রায় চৌধুরী ১৮০৯ সালে কালীঘাটের বর্তমান মন্দির স্থাপন করেন।

প্রসঙ্গত, বড়িশার সাবর্ণী জমিদারগণের পূর্ব পুরুষ কেশবচন্দ্র রায় চৌধুরী গঙ্গাতীরে আপন জমিদারী ভক্ত অরণ্য মধ্যে জপ তপাদি করতেন। কালীঠাকুরাণীর প্রত্যাদেশ মতে বর্তমান কালীর প্রস্তর খোদিত মুখমণ্ডল প্রাপ্ত হয়ে ওই কুণ্ডুর পশ্চিম তীরে স্থাপন করেন এবং কালীর সেবার জন্য উক্তস্থানের জমি নির্দিষ্ট করে দিয়ে মনোহর ঘোষাল নামক এক ব্যক্তিকে পরিচারক নিযুক্ত করেন। কালীঘাটের বন কেটে তিনি কালীর ইমারত নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। যে স্থানটিকে এখন কালীঘাট বলা হয় তা পূর্বে বড়িশার প্রসিদ্ধ ভূম্যধিকারী সাবর্ণী চৌধুরীদের জমিদারি ভুক্ত চাঁদপুর গ্রাম বলে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে বড়িশার সাবর্ণী জমিদার কেশবচন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয়ের ভ্রাতা কাশীশ্বর রায় চৌধুরী ওই স্থানে একটি ক্ষুদ্র মন্দির নির্মাণ করেন।

কালীঘাটের মন্দিরের মধ্যে এখন কেবল কালীর প্রাপ্ত মুখমণ্ডল প্রতিষ্ঠিত আছে এমন নয়, এই এখন স্বর্ণাদি নির্মিত, বহুমূল্যের অলঙ্কারাদিতে পরিশোভিত হয়েছে। এই সমস্ত অলংকার বহু ধনাঢ্য লোকের প্রদত্ত। প্রথমে খিদিরপুর নিবাসী স্বর্গীয় দেওয়ান গোকুলচন্দ্র ঘোষাল মহাশয় কালীর চারিটি রৌপ্যময় হস্ত করে দেন। বর্তমান চারটি স্বর্ণ নির্মিত হাত প্রদান করেন কলকাতার প্রসিদ্ধ বাবু কালীচরণ মল্লিক মহাশয়। চারহাতের চারগাছি সুবর্ণ কঙ্কণ চড়কডাঙা নিবাসী কালীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতামহ রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদান করেন। কালীর স্বর্ণজিহ্বাটি পাইকপাড়াধিপতি রাজা ইন্দ্র চন্দ্র সিংহ বাহাদুর প্রদান করেন। এইরূপ বহু স্বর্ণালংকার বহু ধনাঢ্য লোকের দ্বারা প্রদান করে।

কালীর মন্দিরের পশ্চিম দিকে শ্যামরায় বিগ্রহের অধিষ্ঠান মন্দিরও দোলমঞ্চ। কালীর সেবাইত হালদারগণ পূর্বপুরুষ ভবানীদাস বৈষ্ণব ছিলেন। শ্যামরায় বিগ্রহ তিনি কালীঘাটে নিয়ে আসেন। ১৭২৩ সালে মুর্শিদাবাদের জনৈক কাননগু কালীঘাটে এসে শ্যামরায়ের জন্য ছোটো ঘর প্রস্তুত করে দেন। ১৮৪৩ সালে বাওয়ালীর জমিদারের পূর্বপুরুষ উদয়নারায়ণ মণ্ডল মহাশয় শ্যামরায়ের ছোটো ঘর ভেঙে বর্তমান মন্দির নির্মাণ করে দেন। দোলযাত্রার দিন শ্যামরায়ের প্রধান উৎসব। পূর্বে শ্যামরায়ের দোলমঞ্চ ছিল না তাই মন্দিরেই দোল পালন করা হত। ১৮৫৮ সালে সাহানগর নিবাসী মদন কলে নামক এক ব্যক্তি শ্যামরায়ের দোলমঞ্চ নির্মাণ করেন।

অতুলকৃষ্ণ রায়ের মতে সতী-অঙ্গ বর্তমান চৌরঙ্গী অঞ্চলে পড়েছিল, তাই তার নাম চৌরঙ্গী। যদি এই মত সত্য বলে ধরা হয় তাহলে দেবীর মূর্তি ও মন্দির কালীঘাটে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে চৌরঙ্গী অঞ্চলেই হত। তপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘পলাশির যুদ্ধ’ লিখেছেন, কালীঘাটের ভদ্রকালী কালিকা কালীক্ষেত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। নকুলেশ্বর মহাদেবের সঙ্গে তিনি সানন্দে বিরাজ করছেন। পূর্ণেন্দু পত্রী ‘ছড়ায় মোড়া কলকাতা’য় লিখেছেন, “এঁরা(সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারি)মধ্যেই কালীঘাট। বুড়িগঙ্গার তীরে এঁরাই কালীঘাটের মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। সামাজিক নিয়মে বাধে বলে নিজেরা পুজো করতে পারেন না। তাই দূর দেশ থেকে ডেকে আনা হল হালদার গোষ্ঠীর ব্রাহ্মণ। সেই থেকে ঐ হালদাররাই মন্দিরের সেবাইত।”

দূরদূরান্ত থেকে সাধারণ ভক্তবৃন্দ ছুটে আসে এই কালীঘাটে, মায়ের চরণে কালীপুজোর দিন পুষ্পাঞ্জলি দিতে। কালীপুজোর দিন কালীঘাটে হয় দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। এও এক বিশেষত্ব কালীঘাটের। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে কালীঘাটের কাহিনী আর কালীঘাটের কাহিনীর মধ্যে মিশে আছে সাবর্ণ চৌধুরীদের নাম আর কালীঘাটের সেবায়েত হিসাবে হালদার পরিবারের নাম। দীপান্বিতা কালীপুজোর অমাবস্যাতিথিতে মাকে দুপুরে নিবেদন করা হয় সাদাভাত, পোলাও, পাঁচ রকমের ভাজা, শুক্তো, পাঁচ রকমের মাছ, পাঁঠার মাংস, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। সন্ধ্যাবেলাতে নিবেদন করা হয় লুচি, পাঁচ রকমের ভাজা, মিষ্টান্ন। সঙ্গে থাকে নারকেল নাড়ু, কদমা, বাতাসা ইত্যাদি। কালীঘাট মহাশক্তিপীঠ, সকল সতীপীঠের শ্রেষ্ঠ পীঠ এই কালীপীঠ। আজও কালীঘাট অনন্য। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিত্যদিন পুজো দিতে আসেন এখানে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...