কোথাও দেবীর ভোগে থাকে লাউ চিংড়ি, কোথাও চন্দনীক্ষীর- আচারের বৈচিত্র্যে উত্তর কলকাতার বিখ্যাত বনেদি পরিবারের কালীপুজো

দেবী শ্মশানবাসিনী। বিকটা দশনা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। প্রলয়ঙ্করীর কন্ঠে দোলে মুন্ডমালা। কটিতে খন্ডিত হস্ত। এহেন বিভীষিকাময়ীই কিন্তু বাংলার ঘরের মা। সমস্ত দেবদেবী গৌরবর্ণা হলেও  তাঁর গায়ের কৃষ্ণবর্ণ, অনার্যরুপ করে তুলেছে তাঁকে বাঙালির শ্যামা মা। যে কৃপাময়ীর কাছে ভক্ত হয়ে ওঠে কোলের ছেলে। তাঁর রাঙা চরণে ঠাঁই পেতে চাই। শ্নশানবাসীনী তখন শান্ত। সন্তানের জন্য বরদা রূপ নেন দেবী। রক্ত মত্ত করালবদনা শ্মশান-মশান ভুলে ঘরের মা। রক্তজবা আর ভক্তের মা ডাকে সন্তুষ্ট।

রামপ্রসাদ সেন, ব্যামাক্ষ্যাপা, কমলাকান্তর মতো কালীভক্ত সন্তানের সূত্রেই বাঙালির মা হয়ে উঠেন দেবী কালী। এই বাংলা কালীক্ষেত্র।  দেবী কালী তান্ত্রিক আসনে যেমন পূজিতা তেমনি তিনি পুজিত হন গৃহস্থের ঘরেও। দুর্গা পুজোর মতোই নানা বৈচিত্রময় আচারে দীপান্বিতা অমাবস্যায়  তাঁর পুজো হয়। কলকাতার উত্তর বিখ্যাত কালী পুজোর জন্য।  কলকাতার কয়েকটি  বনেদি বাড়ির কালীপুজোর কথা  রইল নিবন্ধে        

শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ি (জোড়াসাঁকো)— জোড়াসাঁকো অঞ্চলে ১৯৪০ সালে এই পুজো শুরু করেছিলেন শিবকৃষ্ণ দাঁ ১৮৪০-এ। এখানে  দেবীর গায়ের রং গাঢ় বেগনি। বৈষ্ণব পরিবার বলে কোনও বলিদান হয় না। অন্নভোগ হয় না। দেবীকে নিবেদন করা হয় লুচিভোগ। সঙ্গে থাকে ভাজা, তরকারি, মিষ্টি।  

হাটখোলার দত্তবাড়ি (নিমতলা ঘাট স্ট্রিট)— হাওড়ার আন্দুল দত্তচৌধুরী পরিবারের রামচন্দ্র দত্ত অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে উত্তরকলকাতার হাটখোলায় বসতি স্থাপন করেন। বাড়িতে দুর্গোৎসব ও কালীপুজো শুরু করেছিলেন তিনি। মদনমোহন দত্ত লেনের পুরনো বাড়িতে এখনও সেই পুজো হয়। পরবর্তী কালে রামচন্দ্রের পৌত্র জগৎরাম দত্ত নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে এক প্রাসাদোপম গৃহ তৈরি করে পুজো শুরু করেন। সাবেক কাঠের সিংহাসনে দেবীর অধিষ্ঠান। সাবেক বাংলা শৈলীর প্রতিমা রুপোলি ডাকের সাজে সজ্জিত। বিসর্জনের আগে প্রতিমা বরণ করেন বাড়ির কুমারী মেয়েরা। দেবীর ভোগে থাকে লুচি এবং নানা ধরনের মিষ্টি।

দর্জিপাড়া মিত্রবাড়ির পুজো- দর্জিপাড়া নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের মিত্রবাড়ির কালীপুজো বেশ প্রাচীন। এই বাড়ির দুর্গাপুজোর চেয়েও প্রাচীন কালীপুজো। রয়েছে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের কাহিনিও। আড়িয়াদহ থেকে সুতানুটি অঞ্চলে এসেছিলেন এই পরিবারের জগন্নাথপ্রসাদ মিত্র। দর্জিপাড়া মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। তাঁর পৌত্র দূর্গাচরণ ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার ‘কোর্ট জুয়েলার’। এছাড়াও তাঁর বহুবিধ ব্যবসা ও নুনের দেওয়ানি ছিল। সেই কাজের দফতরে একদা কাজ করতে আসেন সাধক-কবি রামপ্রসাদ সেন। হিসেবের খাতায় তাঁর লেখা গান পড়ে খুশি হয়ে হয়ে দুর্গাচরণ রামপ্রসাদকে আজীবন মাসোহারার ব্যবস্থা করে দেন। এই পরিবারের নীলমণি মিত্রর পৌত্র প্রাণকৃষ্ণ কিশোর বয়সে একবার খেলার ছলে কালী মূর্তি গড়ে বসেন। সেই থেকে পুজো আরম্ভ। পরিণত বয়সে তিনি ভদ্রাসন সহ ঠাকুরদালান নির্মাণ করে দুর্গাপুজোও আরম্ভ করেন। কিশোর বয়সে দেবীমূর্তির শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা না জানার ফলে প্রাণকৃষ্ণ ভুল করে শিবের বুকের উপরে কালীর বাঁ পা রেখে দক্ষিণাকালীর প্রতিমা তৈরি করেছিলেন। সেই ‘ভুল’ বজায় রেখে আজও সেই ভাবেই গড়া হয় এখানকার প্রতিমা।

মার্বেল প্যালেস (মুক্তরামবাবু স্ট্রিট)— সাবেক চোরবাগান অঞ্চলে প্রাসাদ বানিয়ে ১৮৪০ সালে পুজো শুরু করেছিলেন রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক। ঐতিহ্য মেনেই প্রতিমার সাবেক রূপটি আজও অপরিবর্তিত। প্রতিমার সাজও সাবেকী। প্রতিমার চালি গোলাকৃতি। চার পুরুষ ধরে প্রতিমার অঙ্গরাগ ও সাজানোর কাজ করছেন বাগনানের কাশীনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবার। বংশ পরম্পরায় প্রতিমা গড়েন মৃৎশিল্পী। তেমনই ডোমজুর থেকে পাঁচ পুরুষ ধরে আসেন ঢাকিরা। বৈষ্ণব পরিবার বলে পুজোয় কোনও বলিদান হয় না। পুজোয় উৎসর্গ করা হয় ১০৮টি প্রদীপ। ভোগে থাকে লুচি, ভাজা, দই, রসকরা, সন্দেশ, চন্দনীক্ষীর। এ ছাড়াও পুজোয় তালের ফোঁপল ও করবী ফুল দেওয়া হয়, যা আনা হয় বাড়ি সংলগ্ন নীলমণি নিকেতন থেকে। প্রতিপদের দিন বাহকের কাঁধে চেপে আজও প্রতিমা বিসর্জনে যান।

বউবাজার মতিলালবাড়ি (দুর্গা পিতুরি লেন)— জয়নগর-মজিলপুরের মতিলাল পরিবারের বিশ্বনাথ মতিলাল অকালে পিতৃহারা হয়ে মাতুলালয়ে চলে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সরকারি নুন গোলার সামান্য চাকুরে থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণ বিভাগের দেওয়ান হন। পরবর্তী কালে তিনি মামার সম্পত্তি লাভ করে পুজোর ভার গ্রহণ করেন। এখানকার প্রতিমা শ্যামাকালী। পুজো হয় বৈষ্ণবরীতি মেনে। ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদা ভাত, মাছের মুড়ো দিয়ে ডাল, ছ্যাঁচড়া, লাউ চিংড়ি, নানা ধরনের মাছ ইত্যাদি।

হালদার বাড়ি (বউবাজার)- কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের রামনাথ কবিরাজ লেনের হালদার বাড়িতে কালী পুজো ৩০০ বছরের পুরনো। সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে লক্ষ্মীনারায়ণের হাত ধরে হালদার বাড়ির পুজো শুরু হয়।  লক্ষ্মীনারায়ণ হালদার ছিলেন বাদলা গ্রামের জমিদার। কলকাতায় লক্ষ্মীনারায়ণের বাবার অনেক জমিজমা থাকার সুবাদে তিনি কলকাতায় এসে ব্যাবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে হালদাররা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন। কুমারটুলি থেকে মৃৎশিল্পী এসে হালদারবাড়িতে কালীপ্রতিমা নির্মাণ করেন। কালীপ্রতিমার কাঠামো পুজো হয় দুর্গাষ্টমীর দিন আর মূর্তি গড়া শুরু হয় কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন। হালদার বাড়ির কালীপুজোর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য মোমবাতির আলোয় কালীপূজোর আয়োজন। ব্রিটিশ আমলে ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত ইস্পাত উৎপাদনকারী সংস্থা শেফিল্ডের মালিক জন ইয়েটস হালদার বাড়ির কালীপুজো দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি খুশি হয়ে তাঁর কম্পানির ইস্পাত দিয়ে তৈরি দুটি খড়্গ জাহাজে করে পাঠিয়ে ছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল বেশি ওজনের, দেখতে রুপো নির্মিত খড়গের মত। কালীপুজোর রাতে এই খড়্গ ব্যবহার করা হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...