মাতৃ আরাধনায় বেশিরভাগ জায়গায় পাঁঠা বলির প্রথা চালু আছে। শাক্ত মতে,পুজো হলে সব জায়গায় পাঁঠা বলি হয় আর যদি মায়ের পুজো হয় বৈষ্ণব মতে, তাহলে ছাঁচি কুমড়োর বলি হয়। সচরাচর যেখানেই মায়ের পুজোতে বলি হয়, সেখানে পুজো অনেক বেশি কঠিন এবং কষ্টসাধ্য হয়, অনেক ক্ষেত্রে বাড়ির মানুষেরা হয়তো বলিদান প্রথা আর চান না, কারণ এক কোপে বলি না হলে নতুন করে আবার বলির আয়োজন করতে হয়,তাছাড়া মায়ের রোষ ও পরে পরিবারে, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে বলে এই প্রথাটিকে তারা উঠিয়ে দিতেও পারেন না। তবে এমনও জায়গা আছে, যেখানে বলির সময় মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন, সেই কারণে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় মাকে। হ্যাঁ বন্ধুরা, আজ আমি আপনাদের বলবো, ধনেখালির কেশবপুরের জাগ্রত কালীর কথা।
ধনেখালির ভান্ডারহাটির কেশবপুরের কালী মা অত্যন্ত জাগ্রত। আনুমানিক ৪০০ বছরের পুরোনো এই কালীপুজো, তাই স্বাভাবিক ভাবেই বহু বছরের পুরোনো এই পুজো দেখতে প্রতি বছর কার্তিক মাসের অমাবস্যায় লক্ষ লক্ষ ভক্ত ভিড় করে আসেন মায়ের মন্দিরে। কেশবপুরের এই কালী মায়ের আবির্ভাব সম্পর্কেও আছে অলৌকিক লীলা কথা, কথিত আছে যে, এই গ্রামের পাশ দিয়ে বদরদহ নামে খাল বয়ে যেতো, অনেক অনেক বছর আগে, কালী পুজোর আগের দিন ভোরে খালের পাশে তিন হাতের কালী প্রতিমা দেখতে পান গ্রামের মানুষ, কীভাবে এই প্রতিমা গ্রামে এলো? তা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায় চারিদিকে। কিন্তু কেউ বলতে পারে না, কীভাবে কালীপুজোর ঠিক আগেই মায়ের এই মূর্তির আবির্ভাব হলো তাদের গ্রামে, তবে এই ঘটনাকে নিছক কাকতালীয় বলে উড়িয়েও দিতে পারেন না গ্রামবাসীরা, গ্রামবাসীদের মনে সেই দিন স্থির বিশ্বাস হয় যে, এই গ্রামের প্রতি মায়ের বিশেষ কৃপাদৃষ্টি রয়েছে। তাই মায়ের পুজোর আয়োজন করেন তারা। আজও তাই এই গ্রামের প্রধান পুজো এটি, যে কারণে মায়ের এই পুজোর সময় প্রত্যেকটি বাড়িই যেন উৎসবের আকার নেয়, প্রতি বাড়িতেই প্রচুর আত্মীয়-স্বজন আসেন মায়ের এই পুজো উপলক্ষে, কোনো কোনো বাড়িতে আবার প্যান্ডেলও করা হয়। মা ব্যান্ডপার্টি ও বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি পছন্দ করেন বলে, তারও আয়োজন করা হয়।
তবে শুরুর দিকে কিন্তু এত সমারোহ ছিলো না, প্রথম যখন মায়ের পুজো শুরু হয় তখন মাথায় একটা তালপাতার ছাউনি দিয়েই মাকে রাখা হয়েছিলো। এরপর দক্ষিণাকালীর ওপর গ্রামবাসীদের বিশ্বাস ক্রমশ বাড়তে থাকে, মায়ের মাহাত্ম্য কথা ছড়িয়ে পড়লে প্রচুর মানুষ এই মন্দিরে আসেন, তখন এই মন্দির পাকা হয় আর মন্দিরের দক্ষিণ দিকে তৈরি হয় দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দির। ৪০০ বছর আগে যখন এই মা গ্রামে এসেছিলেন, তখন এলাকার মহারাজ ছিলেন বর্ধমানের রাজা উদয়চাঁদ মহাতপ,তাঁর নির্দেশেই সেদিন মায়ের পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল ,এই কারণে আজও এই পুজোকে বর্ধমানের মহারাজার পুজো বলেন অনেকে। চার বছর আগেও বর্ধমানের রাজ পরিবার থেকে পাঁঠা আসতো মায়ের বলির জন্য।
বছরে দুই বার করে এই মায়ের পুজো হয়, কার্তিক মাসের অমাবস্যায় ও বৈশাখ মাসের শেষ শনিবারে। বৈশাখ মাসে অবশ্য মায়ের পুজো হয় ঘটে, কার্তিক মাসের অমাবস্যায় অনেক পাঁঠা বলি দেওয়া হয় মায়ের কাছে, অনেকে পাঁঠা মানসিকও করেন।
মাকে ভক্তি ভরে ডাকলে মা সকলের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। শিব মন্দিরের পুরোহিত রণজিৎ হালদারের কথায়, এই মন্দিরকে ঘিরে অনেক ঘটনা রয়েছে, নানা ভাবে মা গ্রামবাসীদের রক্ষা করে চলেছেন, একবার যেমন অপরাধজনিত কারণে গ্রামের একজনের ফাঁসির সাজা হয়ে ছিলো, পরিবারের সদস্যরা দেবীর কাছে আরাধনা করেন, ফাঁসি যেন রদ হয়, শেষ পর্যন্ত মায়ের অলৌকিক লীলায় সেই ব্যক্তি ফাঁসির সাজা থেকে মুক্তি পান আর মায়ের প্রতি ভক্তি, বিশ্বাস, আস্থা আরও বেড়ে ওঠে সাধারণ মানুষের মনে।
এই মন্দিরকে ঘিরে শিউরে ওঠার মত ঘটনা এটাই যে, বলির সময় মা রুদ্র মূর্তি ধারণ করেন, ভক্তরা যদি ভয় পায়, সেই কারণে মাকে সেই সময় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। মায়ের মন্দিরের ভেতরে কিন্তু আজ অবধি আলো প্রবেশ করে নি। আজও মায়ের পুজো হয় মোমবাতি ও প্রদীপের আলোতে। মন্দির কর্তৃপক্ষ যে আলো দেওয়ার ব্যবস্থা করে নি, এমনটা কিন্তু নয়, দেবীর নির্দেশেই আজও এই মন্দিরের ভেতরে বিদ্যুতের আলো নেই। এই প্রসঙ্গে ও একটি অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে, যখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলো না তখন একবার জেনারেটর ভাড়া করে মন্দিরের ভেতরে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো কিন্তু তখন মন্দিরের ভেতরে আলো ও জেনারেটর দুটোই পুড়ে যায়। তখন তারা মায়ের ইচ্ছা বুঝতে পারে, এরপর থেকে আর কখনো মন্দিরের ভিতরে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে নি মন্দির কর্তৃপক্ষ। কালী পুজোর পরের দিন এখানে মায়ের বিসর্জন হয় সন্ধ্যায়, বিসর্জনের সময় পাশের পাড়া থেকে ছোট মা আসেন কিছুক্ষনের জন্য। এই মন্দিরের সামনে দুই প্রতিমাকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়, এরপর দুটি আলাদা ঘাটে বিসর্জন হয় প্রতিমার। তারপর অপেক্ষা শুরু হয় এক বছরের... মায়ের আসার...