বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই হল ভারতের নির্যাস। এই ভারত নানা ভাষা, নানা ধর্মের মিলনক্ষেত্র। এদেশে কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন, কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। আবার তিনিই লেখেন, মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। তেমনই এই বঙ্গে একই মন্দিরে পুজো পান, কালী আর পীর। একদিন, দু-দিন ধরে নয়, প্রায় পাঁচ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই মন্দিরে পূজিত হচ্ছেন ভদ্রকালী ও পীর বাবা।
রাঢ় বাংলার পুরুলিয়া জেলার প্রান্তিক এক গ্রাম; শহর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হিড়বহাল গ্রাম। সেই গ্রামেই রয়েছে এই বিচিত্র মন্দির। মন্দিরটি ‘মা ভদ্রকালীর এবং সত্য পীরের মন্দির’ নামে পরিচিত। যেখানে একই মন্দিরে ভদ্রকালী ও পীর বাবার পুজো হয়ে আসছে। বছরের প্রতিটি দিন নিয়ম মেনেই মা কালী ও পীর বাবার পুজো হয়। পয়লা মাঘ হয় বিশেষ পুজো। এই মন্দিরে পীর বাবাকে সত্যনারায়ণ রূপে পুজো করেন পুরোহিত।
কেবল আরাধ্য দেব-দেবতায় নয়, পৌরহিত্যেও এই মন্দির বাকি মন্দিরদের থেকে আলাদা। এখানে কোনও ব্রাহ্মণ পৌরহিত্য করেন না, বংশ পরম্পরায় বাউরি সম্প্রদায়ের মানুষ এই মন্দিরে পুজো করেন। কালী পুজোর সময় কার্তিক অমাবস্যায়, এই মন্দিরে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। এই মন্দিরে পুজোর অন্যতম আকর্ষণ বলি প্রথা। একপাশে পাঁঠা বা ছাগ বলি ও অন্য পাশে মোরগ বা মুরগি বলি দেওয়া হয়।এই মন্দিরেই এক দিকে মা ভদ্রকালী পূজিত হন এবং অন্যদিকে সত্যপীর পুজো পান।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, একদম প্রথম দিকে, এই স্থানে একটি মাটির ঘরে মা ভদ্রকালীর পুজো শুরু হয়েছিল। সেই সময় নিত্যপুজোর দায়িত্বে ছিলেন বাসুদেব বাউরি। কোনও একদিন দৈবাদেশে এই মন্দিরে স্থান পান বাবা সত্যপীর। আজও সেই বাসুদেব বাউরির বংশধরেরাই এই মন্দিরের পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন। অন্যমতে, প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে এই গ্রামের এক সাধু জঙ্গলে সাধনা করছিলেন। সেই সময় তিনি মা কালীর স্বপ্নাদেশ পান এবং তখন থেকেই ওই গ্রামে ভদ্রকালীর পুজোর শুরু হয়। কিছুদিন পরেই মুসলমান সম্প্রদায়ের এক পীর বাবা সেখানে আসেন।
তিনি হিন্দু পুরোহিতকে কালী মন্দিরে, আল্লাহের পুজো করার পরামর্শ দেন। কিন্তু পুরোহিত অসম্মত হলে, পীর বাবা আল্লাহকে সত্যনারায়ণ জ্ঞানে পুজো করার নিদান দেন। সেই থেকে একই মন্দিরে ভদ্রকালী ও পীর বাবার পুজো শুরু হয়। যে পুজো আজও চলছে। এই মন্দিরে বলি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষ নিজেদের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্যে এই মন্দিরে মা ভদ্রকালীর কাছে ছাগল, হাঁস, পায়রা ইত্যাদি বলি দেয়। আবার কেউ বাবা সত্যপীরের কাছে মোরগ বা মুরগি জবাই দেয়।
মুসলমানদের ইশ্বরকে নিবেদিত এই মোরগ হিন্দু পুরোহিতের হাতেই মুসলমানদের রীতি অনুযায়ী জবাই হয়। সারা রাত ধরে চলে পুজো, তারপর পুজো শেষে বলি আর জবাই দেওয়া মাংস দিয়ে নরনারায়ণ সেবা করা হয়। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ পরম তৃপ্তি সহকারে আহার করেন। শুধু পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন জায়গা নয়, ভিন রাজ্য থেকেও হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষেরা এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। দূর-দূরান্ত, পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড এবং কলকাতা, আসানসোল থেকেও বহু মানুষ এখানে আসেন। এখানেই আলি আর কালী মিশে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন।