আজ যে কালী মায়ের কথা বলবো, তিনি হলেন ছিন্নমূল মানুষদের দেবী। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থানার কুলপুকুরে বিরাজ করেন দেবী কালিকা। তাঁর নাম কুলপুকুরের কালী। শহর হাবড়া থেকে বেরিয়ে গাইঘাটার দিকে যেতে যশোর রোডের পাশে কুলপুকুর কালী মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সড়ক যশোর রোড। আধুনা যা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক নামে পরিচিত। মন্দিরের গায়ে লাগানো প্রতিষ্ঠা ফলক থেকে জানা যায়, বাংলার ১৩৬১ সনের ফাল্গুন মাসে দেবীর আরাধনা শুরু হয়েছিল। ১৪০০ সনে সংস্কার করে ফের মন্দির তৈরি করা হয়। প্রতিদিন মায়ের নিত্যপুজো হয়। পাশাপাশি ফাল্গুন মাসে বাৎসরিক পুজো হয় মন্দিরে। কালী মন্দিরের মা জাগ্রত বলে বিশ্বাস করেন বহু মানুষ। ভক্তরা মনে করেন, মন থেকে মায়ের কাছে কিছু চাইলে কাউকেই ফেরান না মা।
কুলপুকুর কালী মন্দিরে মায়ের প্রতিমা ছাড়াও রয়েছে শিবলিঙ্গ এবং মা মনসার মূর্তি। মন্দিরে প্রতিদিন দুবেলা মায়ের পুজো হয়। বেলা ১২ টা ও সন্ধ্যা ৭টায় পুজো দিতে আসেন ভক্তেরা। ভক্তদের জন্য ভোগের প্রসাদের ব্যবস্থাও থাকে। কলকতা থেকে সড়কপথে সহজে চলে আসা যায় কুলপুকুর কালী মন্দিরে। যশোর রোড ধরে সোজা চলে আসা যায় মন্দিরে, রাস্তার একেবারে লাগোয়াই মন্দির। ট্রেনে আসতে হলে শিয়ালদহ থেকে হাবড়া স্টেশনে নামতে হবে। হাবড়া থেকে গাইঘাটাগামী অটো বা বাসে কুলপুকুর কালী মন্দিরে পৌঁছনো যায়।
দেবী জাগ্রত কালী মা হিসাবেই পরিচিতা। তাঁকে ঘিরে আজও বহু অলৌকিক কাহিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে মুখে ঘোরে। রাত বাড়লেই জেগে ওঠেন এই মন্দিরের আরাধ্য দেবী। আজও তাঁর মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যানবাহনের গতি রহস্যময়ভাবে কমে যায়। গভীর রাতে শিশুকন্যা রূপে জাতীয় সড়কের ওপর দেখা দেন স্বয়ং মা। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, জাতীয় সড়ক ধরে যাতায়াতের পথে দূরপাল্লার গাড়ির চালকরা গভীর রাতে রাস্তার ওপরে কোনও শিশুকন্যাকে দেখেছেন আবার কেউ কেউ দেখেছেন বুড়ি মাকেও। হাত নেড়ে তাঁরা গাড়ি আস্তে চালানোর কথা বলছেন। কত লোক দেখেছে! ফাল্গুনী অমাবস্যায় দেবীর অকালবোধনের পুজো শেষে বাড়ি ফেরার পথে পুরোহিতরা অনেকেই পথ ভুল করে ফেলেন। নির্জন মাঠের মধ্যে তাঁরা ঘুরপাক খান। মা তখন তাঁদের পথ দেখিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেন।
দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল মানুষ এপার বাংলায় ছুটে এসেছিলেন আশ্রয়ের আশায়। ঠাঁই মিলেছিল। জুটেছিল শরণার্থী তকমা। যশোর, খুলনা ও বরিশালের বহু মানুষ কাঁটাতারের এপারে বনগাঁ, গাইঘাটা, হাবড়া, অশোকনগর, গুমা, বিড়ার বিভিন্ন রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কথিত আছে, বরিশালের কোনও এক গ্রামের সকল বাসিন্দারা যখন দেশ ছাড়ছেন, তখন তাঁদের পূজিতা কালী মা হাত নেড়ে পিছু ডেকেছিলেন। তাঁদের মা বলেছিলেন, তোরা সবাই চলে যাচ্ছিস। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবি না? বাসিন্দারা থমকে দাঁড়ালেন। একে অপরের মুখ চাইলেন। গন্তব্য অনিশ্চিত, কতটা পথ যেতে হবে, আদৌ যাওয়া যাবে কিনা কেউ জানেন না। কালী মায়ের মূর্তি সঙ্গে করে এতটা পথ যাওয়া সম্ভব নয়। তাই, মায়ের পা ছুঁয়ে তাঁরা শপথ করে এসেছিলেন, নতুন দেশে পৌঁছে মন্দির গড়ে পুজো শুরু করবেন। বরিশাল থেকে সেদিন মায়ের ঘট ও থানের মাটি সঙ্গে এনে ছিলেন তাঁরা। বহু পথ হেঁটে ক্লান্ত মানুষগুলো সেদিন গাইঘাটায় যশোর রোডের পাশে একটি পুকুরপাড়ের কুলগাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই মায়ের ঘট ও মাটি দিয়ে একচালা মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। শুরু হয়েছিল পুজো। কুলগাছ ও পুকুর, দুয়ে মিলে কালী মায়ের মন্দিরের নামকরণ হয় কুলপুকুর মন্দির। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় ষাট বছর।
প্রতি বছর ফাল্গুনী অমাবস্যায় মায়ের অকালবোধন হয়। বাসিন্দাদের বিশ্বাস, কুলপুকুরের কালী মা ভক্তের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। মা কখনও কাউকে খালি হাতে ফেরার না। তাই, আজও বিভিন্ন তিথিতে মায়ের মন্দিরে হাজার হাজার ভক্তের ভিড় জমে যায়। মায়ের মন্দিরে দেশ-বিদেশের বহু ভক্ত এসে মানত করেন। ফাল্গুন মাসে মহাসমারোহে দেবীর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর পুজো হয়। আনন্দ উৎসব নাচ গানের মধ্যে দিয়ে আনা মন্দিরে আনা হয় মা-কে। লক্ষাধিক ভক্ত সমাগম হয়। রাতভর চলে বিশেষ পুজো। সেজে ওঠে গোটা মন্দির প্রাঙ্গণ। সুবিশাল মাতৃ মূর্তি নিয়ে প্রায় কয়েক কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে চলে শোভাযাত্রা। রাস্তার দু'পাশে বহু মানুষ ভিড় করেন মাকে দেখার জন্য। এক শনিবার পার্শ্ববর্তী পুকুরে দেবীর বিসর্জন দিয়ে, পরের শনিবারে দেবীকে মন্দিরে নিয়ে আসার রীতি রয়েছে। মা মৃন্ময়ী, স্বর্ণালংকারে ভূষিতা, পদতলে থাকেন শিব। তিমির অমাবস্যার মতো দেবীর গাত্র বর্ণ কালো।
সাংসারিক সমস্যা থেকে রোগভোগ, পড়াশোনা থেকে চাকরি; মাকে মনের কথা জানালে কাউকেই ফেরার না কুলপুকুরের জাগ্রত মা কালী, এই বিশ্বাস নিয়েই ভক্তেরা আসেন। পুজো দেন।