আজ কালী কথায় রাঢ় বাংলার কথা। পুরুলিয়া জেলা মানেই টিলা আর পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা শিমুল-পলাশ লাল মাটির এক রূপকথার দেশ। সঙ্গে পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌয়ের ছন্দ তো আছেই। তবে, অচেনা এক পুরুলিয়া লুকিয়ে রয়েছে পরিচিত পুরুলিয়ার মধ্যে। পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চা থানা এলাকায় রয়েছে এক কালীমন্দির, মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একজন মুসলমান পুলিশ অফিসার। আজও এই মন্দিরের পুজো উপলক্ষ্যে হিন্দু-মুসলান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্ম নির্বিশেষে এগিয়ে আসেন, সক্কলে চাঁদাও দেন। প্রতি বছর কার্তিক অমাবস্যায় অর্থাৎ কালীপুজোর সময় দূর-দূরান্ত থেকে সহস্রাধিক ভক্ত জমায়েত হন এই মন্দিরে।
এই মন্দির প্রতিষ্ঠার গোড়ার কথা বলি। একদা পুঞ্চা থানার ওসি ছিলেন জনৈক জিটি লতিফ। কথিত আছে, সেই পুলিশ অফিসারকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন মা কালী। স্বপ্নে দেবী আদেশ দিয়ে বলেছিলেন মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। পরের দিন সকালে হাঁটতে বেরিয়ে, তিনি এক পাহাড়ের চূড়ায় এক কালো পাথরের ওপর দেবীর পায়ের ছাপ দেখতে পান। তখন চারপাশের গ্রামের মানুষকে খবর দেন ওই পুলিশ অফিসার। তারপর গ্রামবাসীরা মিলে পাহাড়ের চূড়ায় এক মিলিটারি ক্যাম্পে মা কালীর আরাধনা আরম্ভ করেন। এই পাহাড়ের নাম আগে চরণপাহাড়ি ছিল না। ব্রিটিশ আমলে এই পাহাড়টি ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হত। জিটি লতিফ মায়ের স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর এই পাহাড়ে একটি পাথরে মায়ের চরণচিহ্ন দেখতে পান। তারপরই এই পাহাড়টির নাম হয় চরণপাহাড়ি। পুজো উপলক্ষ্যে এখানে বসে বিশাল মেলা। পুঞ্চার এই চরণপাহাড়ি হয়ে ওঠে এক মহামিলনক্ষেত্র। এই মন্দির ঘিরে রয়েছে একাধিক রহস্য, বিজ্ঞানে তার উত্তর মেলে না।
একদম প্রথম দিকে, ছোট্ট মাটির এক কুঁড়ে ঘর দেবীর আরাধনা করা হত। তারপর বাংলা ১৩৫৭ সনে জিটি লতিফ সেখানে মন্দির গড়ে তোলেন। এলাকার সাধারণ মানুষ হিন্দু-মুসলামান নির্বিশেষে মন্দির নির্মাণের কাজে এগিয়ে আসেন। বাংলা ১৪০৩ সনে মন্দিরটিকে সংস্কার করেন পুঞ্চা থানার তদানিন্তন ওসি সমর কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মন্দির সম্প্রীতির কথা বলে, মন্দিরের প্রবেশদ্বারের একদিকে লেখা রয়েছে, যত মত তত পথ। আর অন্যদিকে লেখা রয়েছে, যথা ধর্ম তথা জয়। নিচ থেকে পাহাড়ের ওপর মন্দির পর্যন্ত ভক্ত তথা দর্শনার্থীদের জন্য সিঁড়ি রয়েছে। চরণ পাহাড়ি কালীমন্দিরে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পুজো চলছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস করে, এখানে মানত করলে দেবী নাকি ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। হিন্দু-মুসলমান সবার কাছেই এই মন্দির এক তীর্থস্থান।
তবে স্বপ্নদেশ ছাড়াও অন্য একটি কিংবদন্তি রয়েছে মন্দিরের, টিলার উপর ছিল ব্রিটিশ আমলের মিলিটারি ক্যাম্পের ধ্বংসাবশেষ। তা সরাতেই একটি বড় পাথরের গায়ে দেখা যায় দেবীর পায়ের ছাপ। সেই প্রস্তর রেখেই টিলায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ধার্মিক পুলিশ আধিকারিক লতিফ। সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। শুরু হয় দেবীর নিত্য পুজো। সেই থেকে পুজোর নাম হয়ে যায় 'চরণ পাহাড়ি কালী'। আবার কেউ কেউ বলেন, আগাগোড়া ধার্মিক ছিলেন ওই পুলিশ অফিসার। সালটা ১৯৫০, জনশ্রুতি রয়েছে, ওই স্বপ্নেই তিনি জানতে পেরেছিলেন, পাহাড়ের চূড়ায় কালো পাথরের উপর খোদাই করা রয়েছে দেবীর পায়ের ছাপ। স্বপ্নাদেশ ছিল সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবীর নিত্য পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে। দেবীর স্বপ্নাদেশে টিলার উপর পুজোর সূচনা করেছিলেন এক মুসলিম পুলিশ আধিকারিক। আজ তা সর্বজনীন। কালীপুজোয় পুরুলিয়া ছাড়াও ভিন জেলা এমনকি পাশ্ববর্তী রাজ্য থেকেও ভক্তের দল ভিড় জমান।
পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালের পয়লা নভেম্বর বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয় পুরুলিয়া জেলা। মন্দির যখন তৈরি হয়েছিল, দেশ তখন পরাধীন, তৎকালীন বিহারের মানভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল পুঞ্চা। সেখানে ইংরেজদের হাতে তৈরি হয়েছিল একটি পুলিশ ফাঁড়ি। পরবর্তীতে সেটাই হয়ে উঠেছে পুঞ্চা থানা। তার অদূরেই উঁচু টিলা স্থানীয়দের কাছে চরণ পাহাড়ি বলে পরিচিত। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল ওই পাহাড়ে অধিষ্ঠিত আছেন দেবী কালী। তবে দুর্গম ওই জায়গায় কোনও মন্দির ছিল না। সাধারণের যাতায়াতও তেমন একটা চোখে পড়ত না। তখন মাঝেমধ্যে তান্ত্রিকরা এসে সেখানে পুজো করতেন। জিটি লতিফের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের বিভিন্ন সময় সংস্কার করা হয়েছে মন্দিরের। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে পাথরের স্থায়ী কালীমূর্তি। নিচ থেকে টিলায় ওঠার জন্য রয়েছে সিঁড়ি। এখনও পাহাড়ের উপরের কালী মন্দিরে পুজো হয়। মায়ের টানে ১৬০টি সিঁড়ি বেয়ে ১৩০ ফুট উঁচুতে থাকা মন্দিরে ছুটে যান ভক্তরা। হাজার হাজার ভক্তের সমাগমে হয় চরণ পাহাড়ি কালী মন্দিরে। তবে এই মন্দিরে দেখা মেলে মেলবন্ধনের ছবির। সম্প্রীতির অনন্য নজির। সাত দশকেরও বেশি সময় আগে পুরুলিয়ার পুঞ্চায় এক মুসলমান পুলিশ আধিকারিকের হাতে যে পুজো শুরু হয়েছিল, সেই পুজো আজও চলছে।
এমনই সম্প্রীতির আরেক কালী মন্দিরের কথা বলে যাই। ১৫০১ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৫১ পীঠের অন্যতম হল মা ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দির। কথিত আছে, ত্রিপুরার এই অংশে দেবীর ডান পায়ের অংশ পড়েছিল। দেবীকে এখানে ষোড়শী রূপে পুজো করা হয়। এই মন্দিরে দেবী ১৬ বছরের এক বালিকা। কালী কা পূরাণ অনুযায়ী, দশমহাবিদ্যার এক রূপ হলেন ষোড়শী। চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে এই মন্দিরের মায়ের মূর্তি নিয়ে আসা হয়েছিল। জনশ্রুতি রয়েছে, তৎকালীন মহারাজা ধন্য মাণিক্য এখানে নারায়ণের মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু মহারাজ মাতৃ মন্দির প্রতিষ্ঠার স্বপ্নাদেশ পান। কোথায় মূর্তি পাওয়া যাবে, সে নির্দেশও পান তিনি। নির্দেশ অনুযায়ী, চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে মায়ের মূর্তি থেকে নিয়ে আসেন মহারাজা। মন্দিরের স্থানটি কচ্ছপের পিঠের আকারের। মূল বিগ্রহের পাশে রয়েছে আরও একটি ছোট বিগ্রহ। তাঁকে বলা হয় ছোট মা। শোনা যায়, মহারাজা যখন যুদ্ধে যেতেন বা শিকারে যেতেন তখন ছোট মাকে সঙ্গে নিতেন। সেখানেও পুজো করতেন, মাতৃভক্তি ছিল প্রবল। কষ্টি পাথরের মূর্তি নিয়েও গল্প রয়েছে। মন্দিরের সামনেই রয়েছে সুবিশাল জলাশয়, যার নাম কল্যাণ সাগর। জলে প্রচুর কচ্ছপ এবং বড় মাছ রয়েছে কিন্তু কেউ কখনও তা শিকার করেন না। কচ্ছপ নিয়ে একটি কাহিনি প্রচলিত রয়েছে এখানে। মৃত্যুর আগে ৫২টি সিঁড়ি অতিক্রম করে প্রতিটি কচ্ছপ মন্দিরের সামনে গিয়ে দেহ রাখে। স্থানীয়দের মতে, এই ৫২টি সিঁড়ি একক বছরের চক্রাবর্ত। ভারত, বাংলাদেশসহ নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এসে এখানে ভিড় জমান। এই মন্দিরে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, সব ধর্মের মানুষ আরাধনা করতে পারেন এবং আসেনও। এটাই মন্দিরকে অনন্য করে তুলেছে।