কোচবিহারের কামাখ‍্যাগুড়িতে পূজিত হন অসুখনাশক দেবতা কলাসুর

১৪৬৫ খ্রিষ্টপূর্ব নাগাদ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল। বিষ্ণুপুরাণ মতে ১৪৩০ থেকে ১৪৬৫ খ্রিষ্টপূর্বের আশে পাশে রাজা ভগদত্তের রাজত্বকাল ছিল। নরকাসুর এই সময়ের অনেকটা আগেই কামাখ‍্যাপীঠের বদল ঘটিয়েছিলেন।

কামরূপ মূলত চারটে অংশে ভাগ করা ছিল। এক একটা ভাগ, একটি পীঠ। এই পীঠগুলো ছিল কামপীঠ, রত্নপীঠ, সুবর্ণপীঠ এবং চারমণিপীঠ। কোচবিহারকে এই আদি রত্নপীঠের মধ্যে একটি অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তীকালে কোচবিহারের রাজবংশের ইতিহাসের সঙ্গে কামাখ্যাপীঠের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জুড়ে যায় এবং কোচবিহারের রাজবংশের ইতিহাস আলোচনার প্রসঙ্গে একাধিক সংযোগসূত্র মারফত আমরা কামাখ্যাপীঠের কথা জানতে পারি।

Read Also :  Kolkata Metro: পুজোর আবহে কলকাতা মেট্রোর সময়সূচি পরিবর্তন করা হল, জেনে নিন সম্পূর্ণ তালিকা

কামাখ্যাপীঠের মা কামাখ্যা এবং সেই সময়ে রাজা নরনারায়ণকে ঘিরে আরেকটা জনশ্রুতি প্রচলন হয়েছিল। কোচবিহারের রাজবংশের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে দেখা যায় তৎকালীন শাসকদের সঙ্গে শিব কিংবা মা কামাখ্যার মতো দেবদেবীর যোগসূত্র বারবার স্থাপিত হয়েছে। এমনটা শোনা যায় যে রাজা নরনারায়ণ একবার মা কামাখ্যাকে দেখে তাঁর রূপে মুগ্ধ হন। দেবীর অপরূপ রূপে সম্মোহিত হয়ে রাজা দেবীর কাছে প্রেম ভিক্ষা করেন। দেবী কামাখ‍্যা তখন নরনারায়ণকে বলেন যদি “এক রাত্রের মধ্যে আমার জন্য প্রকাণ্ড জলাশয় সমেত প্রাসাদ বানিয়ে দিতে পারেন তবেই আমি এই প্রেম প্রস্তাব গ্রহণ করব"। মহারাজা দেবীর কথা শুনে রাজি হয়ে যান। শুরু করে দেন প্রাসাদ নির্মাণের কাজ। কিন্তু একরাতে প্রাসাদ নির্মাণের কাজ স্বাভাবিকভাবেই শেষ হয় না। দেবী কামাখ‍্যাও রাজার প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে চলে যান।

এদিকে রাজার মনে শান্তি নেই। তাঁর স্বপ্নে শুধুই মা কামাখ্যার রূপের কথা ভেসে আসে। সেই সময় মন্দিরে পূজারী ছিলেন কেন্দু কলাই। রাজা তাঁকে নির্দেশ দেন মা কামাখ্যার নৃত্যের সময় একবার তাঁকে মন্দিরে প্রবেশাধিকার দিতে হবে। কেন্দু কলাই সহজে রাজি হননি। কিন্তু রাজার প্রলোভনে এবং রাজার ভয়ে তিনি রাজি হতে বাধ্য হন। মন্দিরের একটি নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে নৃত্যরত মা কামাখ্যাকে রাজা নরনারায়ণ দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু মা কামাখ‍্যার থেকে বিষয়টা লুকিয়ে রাখতে পারেননি রাজা। দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে নৃত্যরত দেবীর সামনে এসে আবার নিজের প্রেম নিবেদন করেন। মা কামাখ্যা তখন বুঝতে পারেন মন্দিরের পুরোহিতের প্ররোচনাতেই রাজা এই সময় আসতে পেরেছেন। রাগে, অপমানে মা কামাখ্যা কেন্দু কলাইকে হত‍্যা করেন। রুদ্ধ হয়ে নরনারায়ণকে তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন "আজকের পর থেকে আপনার বংশের কেউ যদি আমার দর্শন করে তাহলে তখনই আপনার বংশ লোপ পাবে।"

এই ঘটনার পর থেকে কোচবিহার রাজবংশের কেউ যখন নীলাচল পাহাড়ের পাশ দিয়ে যায় তখন কামাখ্যা পিঠের জায়গাটুকু নিজেদের শরীর আবৃত করে রাখত। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সময়ে আরেকটি অলৌকিক ঘটনার ফলে রাজা ওখানে মন্দির তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। মধ্য কামাখ্যাগুড়ির মা কামাখ্যা ধামে শুরু হয় দেবীর পুজো। তবে নৃপেন্দ্রনারায়ণের পর আবার ওই পুজো বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর আরেক কোচ রাজা হুজি রাজবর রাভা মারা যান। তাঁর ছেলে লখিন্দর রাভা বঙ্কো রাভাকে সঙ্গে করে গয়ায় পিন্ডি দিতে চান। বঙ্কো রাভার মারা যাওয়ার সময় নানান অলৌকিক ঘটনার জনশ্রুতি শোনা গিয়েছিল। এই জনশ্রুতি বৃদ্ধি পায় গয়ায় পিন্ডি দিতে গিয়ে। শোনা যায় তর্পণ করতে গিয়ে একের পর এক অতিলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রথমে বালির মধ্য থেকে দুটো সিঁদুর লাগানো জ্যান্ত পুঁটি মাছ বেরিয়ে আসে। এই পুঁটি মাছ দুটোকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হলে আবার বংকো রাভার পায়ের কাছে আসে একটা সোনার অলংকার। যতবার এই ধরনের জিনিসপত্র ভেসে আসে তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সবচেয়ে শেষে একটি সোনার রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি নাকি ভেসে এসেছিল বঙ্কো রাভার পায়ের কাছে। যথারীতি সেটি কেউ গ্রহণ করেননি তিনি। এদিকে তর্পণ করে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন বঙ্কো রাভা। অসুস্থতার সঙ্গে দেখা দেয় বিকৃতি। তাঁর চোখের রং টকটকে লাল। তাঁকে বাড়ি ফেরানোর চেষ্টা করলে বারবার পালিয়ে যান। তিনি আস্তানা নিয়েছিলেন মা কামাখ্যা ধামের পাশের জঙ্গলে। সেই জঙ্গলে একটা পাকুড় গাছ ছিল। পাকুড় গাছের নীচের গুহায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন বংকো রাভা। ধীরে ধীরে সকলে বুঝতে পারেন বঙ্কো রাভার শরীরে মা কামাখ্যা ভর করেছে।

এরপরেই ওই অঞ্চলের শুরু হয় দেবী কামাখ্যার পুজো। আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য কামাখ্যাগুড়ির আদি মা কামাখ্যা ধামে মা কামাখ্যা এবং অন্যান্য লোকদেবতা, উপদেবতাদের পুজো হয়। প্রত্যেক বছর মেলার সময় আষাঢ় মাসের ১১ তারিখে অম্বুবাচী তিথি দেখে বাৎসরিক পুজো হয়। পুজোর আগে জ্যৈষ্ঠের ১০ - ১১ তারিখ নাগাদ এখানে বাঁশপুজো করা হয়। ১০ থেকে ১৫ ইঞ্চির লম্বা বাঁশকে লাল শালু কাপড়ে মুড়ে মাথায় ত্রিশূল আর চোঙার দিয়ে মন্ত্র পড়ে জাগানো হয়। একে বাঁশ জাগানি গান বলা হয়। এই মা কামাখ্যা ধামেই রয়েছে এক দেবতা কলাসুর। মা কামাখ্যা ধামে মহামেলার দিন মা কামাখ্যার পুজোর পাশাপাশি আরেকটা পুজো আয়োজন করা হয়। খামের ভেতরে কলার ভেলা পুজো করা হয়। তাই এই পুজোর নাম ভেলাপুজো এবং দেবতাকে বলা হয় কলাসুর। পাঁচটা কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানানো হয়। ভেলার ওপর ছাউনির মত করে ঘর বানানো হয়। এই ভেলাকে কলা সুরের প্রতীকী রূপে কল্পনা করে। গ্রামের যত রোগ ব্যাধি সুখ দূরদশা অশান্তি মোরগ এই সকল অশুভ শক্তিকে নাচ করে নিতে পারে কলা সুর। তাই মা কামাখ্যা পূজোর পাশাপাশি মহামেলার দিন ভেলা ভুজো করা হয়। এই পুজোর সঙ্গে জোর যোগ রয়েছে কলাসুরের শরীরে উপড়ানি দেবীমার পুজো। এখানে স্থাপন করা মাগনের ঘটটা হল দেবীর প্রতীকি।

এই পুজোয় দশটা খোল, ফল, কলা, দুধ, দই দেওয়া হয় এবং পঞ্চপ্রদীপ জ্বালানো হয়। তারপর পাঁঠা কিংবা পায়রা বলি দেওয়া হয়। এই কলাসুরের পুজো কেবলমাত্র রাভা সম্প্রদায়ের তান্ত্রিক কোচা হুজিরাই করার অনুমতি পান। অন্য কোন ব্রাহ্মণ পুরোহিতের অনুমতি থাকে না এই পুজো করার।

পুজোর একদম শেষ পর্যায়ে স্থানীয় ছেলেরা সকলে মিলে লাল আর সাদা শালু কাপড়ের মোড়ানো বাঁশ হাতে ধরে ভেলাটার চারদিকে ঘোরে। কলাসুরের পুজো হয়ে গেলে চারজন পুরুষমানুষ ভেলাটাকে কাঁধে করে নদীতে নিয়ে যায় এবং সেখানে গঙ্গা পুজো করেন। মূলত মহাদেবের মাধ্যমে কলা সুরের বধকে উদযাপন করা হয়। অর্থাৎ সকল অশুভ শক্তির নাশ। এভাবেই এইসব লৌকিক দেবতারা মানুষের অন্তরের সঙ্গে মিশে থাকেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...