এপিজে আব্দুল কালামের গাড়ি চালাতেন এই সময়। ৫৭ বছর বয়সী ভি কাদিরেসান এখন তামিলনাড়ুর আরিগনার আন্না গভর্মেন্ট আর্টস কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক।
১৯৭৯ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। ভোপালে ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ট্রেনিং শেষে নিয়োগ পেলেন ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটারিতে। কাজটা অবশ্য ড্রাইভার-কাম-অ্যাসিস্টেন্টের।
সেই সময়ই ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটারিতে আসীন বিজ্ঞানী গবেষক এপিজে আব্দুল কালাম। তাঁরই ড্রাইভার-কাম-অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে এলেন ভি কাদিরেসান।
খুব বেশি সময় লাগেনি সদা স্নেহশীল এপিজে’র কাজের মানুষ হয়ে উঠতে। ভি ক্যাথেরিসানের কথায়, ‘আইয়ার কাছে প্রায় ৫ বছরেরও বেশি সময় ছিলাম। আমি আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি তা তাঁর সংস্পর্শে আসার ফলাফল। তিনিই আমায় গড়েছেন।”
ভি কাদিরেসান ছিলেন একটু অন্যরকম। স্যার কালাম মাঝে মাঝেই দেখতেন ফাঁকা সময়ে তাঁর গাড়ির চালক মুখ ডুবিয়ে আছে বইয়ের পাতায়। নয়ত খবরের কাগজ বা হাতে পত্রিকা। দেখে খুশিই হয়েছিলেন। বাধা তো দেননি, উল্টো অগাধ উৎসাহ জুগিয়েছেন এ অভ্যাস চালিয়ে যাওয়ার।
তিনিই ভি কাদিরেসানকে একসময় পরামর্শ দিলেন নতুন করে পড়াশোনা শুরুর। এ শুধু বই-কাগজ-পত্রিকার বিক্ষিপ্ত পাঠ নয়, একেবারে ক্লাসরুমে, পড়ার বইয়ের কাছে ফেরার। ভি কাদিরেসান তখন বিবাহিত। বাড়ির দায়-দায়িত্ব আছে। কী করে পড়ুয়া জীবনে ফিরবেন তিনি? আশ্বস্ত করেছিলেন আইয়া। আর্থিক সাহায্যও করতেন।
বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে পড়া ছেড়ে কাজের ভাবনা করতে হয়েছিল। দশম শ্রেণীর মাঝপথেই স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে চলে আসেন।
যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই শুরু করলেন আবার। প্রথমে দশম শ্রেণীর বোর্ডের পরীক্ষা। তারপর হায়ার সেকেন্ডারি। তারপর বি.এ শেষ করে মাদুরাইয়ের কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাঠ। এখানেই ধামলেন না, তাঁর নজর আরও দূরে।
১০-৫টা ডিউটি করতেন। সেই কাজে এতটুকু ফাঁকি দেননি কোনওদিন। বাড়ি ফিরে ডুবে যেতেন পড়ায়। চলত মাঝরাত পর্যন্ত। এ রুটিনে কোনও ছেদ নেই।
এদিকে ভি কাদিরেসান যখন একটা একটা করে শিক্ষাঙ্গনের দরজা পার হচ্ছিলেন তারই মধ্যে এপিজে আব্দুল কালাম তামিলনাড়ু ছেড়ে চলে আসেন দিল্লি। কিন্তু যে খিদের আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন তাঁর একদা চালকের মনে তার উত্তাপ এতটুকু কমেনি। আসলে তাঁর চালক যে কখন তাঁর ছাত্র হয়ে উঠেছিল সে খেয়াল দু’জনের কারুরই ছিল না।
১৯৯৬ সালে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটারির চাকরি ছেড়ে যোগ দেন চিফ এডুকেশন অফিসারের দফতরে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দেন ভি কাদিরেসান। উচ্চশিক্ষায় আরও বেশি করে মন দেওয়াই ছিল চাকরি ছাড়ার অন্যতম কারণ। ইতিহাসের পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন তিনি। আরিগনার আন্না গভর্মেন্ট কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন।
এই পর্ব যখন চলছে ভি কাদিরেসান তামিলনাড়ুতে এবং তাঁর আইয়া দিল্লিতে, তখনও তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন। এপিজে আবদুল কালামকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, তিনি ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটারি ছেড়েছেন। উত্তর দিয়েছিলেন কালাম।
যাঁর কারণে জীবনে এমন পরিবর্তন তাঁর চিঠি পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন আরিগনার আন্না গভর্মেন্ট কলেজের নতুন অধ্যাপক। দেশের রাষ্ট্রপতি পদে যোগ দেওয়ার পরেই তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
ভি ক্যাথেরিসানের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। সামান্য জমি আর বসতবাটি এইটুকু সম্বল। তাই দিয়েই কোনওরকমে সংসার চালাতেন তাঁর স্ত্রী। একটা সময় সেভাবে তাঁর বেতনের পুরোটাকাটাই ব্যয় হয়ে যেত বই আর পড়াশোনা। সেই পরিস্থিতি মেনে নিয়েছিল বাড়ির সদস্যরাও।
শুধু কালামসাহেব নন, ভি ক্যাথেরিসানের পাশে দাঁড়িয়েছিল ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটারিও।
আজও মিশাইল ম্যানের কথাই গুরুবাক্য মেনে আসছেন তিনি। জীবনে সফল হতে কঠোর পরিশ্রম আর মেধাচর্চার কোনও বিকল্প নেই।