হাল না ছেড়েই ৭০-এ সুমন

কেউ খিদে নিয়ে গান লেখে/ কেউ খিদে নিয়ে মরে/ বমি মাখা তার মরা মুখে/ মাছি ভন ভন করে...যদি মাছি নিয়ে গান লেখো/ আর জলসায় গাও/ লোকে হাততালি দেবে দেখো/ পেট পুরে তালি খাও...(কবীর সুমন। মাছি ও মরা মুখের গান)...এমনই গানের ও মনের ভাষা ব্যবহারে যিনি বিগত কয়েক দশক যাবৎ বাংলা গান-সংস্কৃতিকে শ্রীমন্ত-সমৃদ্ধ করে তুলেছেন, আজ সেই মহীরুহ- কবীর সুমন তথা হাল না ছাড়ার উদ্ধত-আহ্বায়কের ৭০ তম জন্মদিন

"তিন শতকের শহর

মস্ত গোলকধাঁধা

এখানে পড়েছি আমি

সাতটি পাকে বাঁধা ।"

বাবা শ্রী সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মা শ্রীমতী উমা চট্টোপাধ্যায় তাঁর জন্মের পর মুখে কথা ফোটার সময় থেকেই তাঁকে গান শেখান, নানা ধরনের বাংলা গান। পরে বাংলা গানের একাধিক গুণীজনের সান্নিধ্যে গানে তালিম নেন, শুধু তাই নয় ছেলেবেলায় ফাদার পিন্টো নামে এক ধর্মযাজকের তালিমে ইংরাজিতে 'ট্রেজার আইল্যান্ড'  অপেরায় গাইতে গিয়ে পাশ্চাত্ত্যের গীতিনাট্য আঙ্গিকের কিছু অন্তঃস্থ বিষয় আত্মস্থ্য করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বাড়িতেই গানের ঘরানা, আর তার সুবাদেই তাঁর বড় হওয়ার সর্বক্ষণের সঙ্গী হতে পেরেছিল গান, তিনিও তা চেয়েছিলেন খুব।

"মনে ক'রে নাও এটাই আমার কাজ

প্রতিদিন রেখে আসা জানলায় কল্পগন্ধরাজ।

মনে করে নাও এটাই আমার দায়

এক বার ছুঁয়ে আসা ও-নয়ন প্রতিদিন জানলায়।

মনে ক'রে নাও এটাই আমার নাম

জানি কোনদিন ডাকবে না তুমি, তবুও ব'লে দিলাম।" 

খুব অল্প বয়স থেকেই গ্রামাফোন রেকর্ডে দেশবিদেশের গান শোনা হত তাঁর। সঙ্গীতশিক্ষায় তিনি ভেঙে ফেলেছিলেন জাত-পাত, উচ্চ-নীচ, দেশ-বিদেশ, সময়-অসময়, যাবতীয় ব্যরিকেড। ১৯৬৬ সাল, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের একজন কন্ঠশিল্পী হিসেবে আধুনিক বাংলা গান গাইছেন তখন, ঠিক সেসময়ই তাঁর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সুর বোনার তাগিদ। আকাশবানীর অনুমোদিত কিছু গীতিকারের লেখা গানে সুর করতে ও গাইতে লাগলেন। তিনি নিজে বলেছেন, ছেলেবেলা থেকে ঐ সময় পর্যন্ত (এবং তার পরেও) যেসব আধুনিক বাংলা গান তিনি গেয়েছেন, গুটিকয়েক ব্যতিক্রম ছাড়া তার প্রধান, একমাত্র উপজীব্য ছিল প্রেম। ঐ সালেই কলেজে ঢুকে আধুনিক বাংলা কবিতা পড়তে শুরু ক'রে কথা ও বিষয়ের অন্য এক জগতে প্রবেশ করেন তিনি। পাশাপাশি চলে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় লেখা সাহিত্যের পাঠ। তখন গরম হাওয়া...এক উত্তাল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ। কলকাতার হাওয়ায় হাওয়ায় তখন মার্কসবাদ, মাও-সে-তুঙের চিন্তাধারা, কংগ্রেসী মতবাদ, গ্রুপ থিয়েটার, অগুন্তি কবিতা পত্রিকা, মিছিলে মিছিল আর স্লোগানে স্লোগান, ন্যারো লেনে হারিয়ে যাওয়া বিদ্রোহী যুবকদের কখনও টাটকা রক্ত, কখনও নিঁখোজ লাশ, পুলিশ-বোমা-গুলি-কারফিউ-ভয়।

"দুচোখ বুজে যাও কিচ্ছু চেয়ে দেখো না

দু'কান বুজে যাও কিচ্ছু শুনে দেখো না

কত কী করছে লোকে কত কিছু বলছে লোকে

যাও ভুলে যাও কিচ্ছু মনে রেখো না..."

এসবের রেশ এখনও কাটেনি, শুধু সময়ের এগিয়ে যাওয়া অথবা পিছিয়ে পড়া। 'আগুন দেখেছি আমি...', পীট সিগারের গানের অনুবাদে 'কোথায় গেল তারা', ল্যাংস্টন হিউজ অবলম্বনে 'আমার মত কালো', 'তোমাকে চাই', 'ভগবান কত ভাল', 'ক্যাকটাস তুমি কেঁদো না',  বব ডিলান অবলম্বনে 'কতটা পথ পেরোলে', 'বিরোধীকে বলতে দাও', 'সফদার হশমির লাস', 'মুখ গুলোকে দেখেছো কি?', 'হাল ছেড়ো না...হাল ছেড়ো না বন্ধু...বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে'...... সেই সময় সুমন নামের এক রাগী যুবক শুধু এসবই গান গেয়ে গেছেন,  সমাজের বদ্ধ ভয়-ভাবনা দিনের পর দিন তাঁর অস্ত্র 'গান' (এ অস্ত্র তুলে দেওয়া যায় প্রজন্মের হাতে?!) দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছেন। সে যুবক এখন ৭০ পেরিয়েছেন, এখনও তিনি তাই করেন

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...