শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় গোপসখীদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন বৃন্দা। তিনি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। সেই বৃন্দার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে পাবার জন্য আকুল হয় জলন্ধর নামে এক দৈত্য। সে জানত তাঁকে পেতে গেলে আগে তপস্যা দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে তুষ্ট করতে হবে। তাই অবিলম্বে সে শুরু করে দারুণ কঠিন তপস্যা। জলন্ধরের সেই কঠিন তপে তুষ্ট হয়ে একদিন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাকে সম্প্রদান করেন। বৃন্দাকে পত্নী হিসেবে পাওয়ার পর জলন্ধরের আকাঙ্ক্ষা জাগে যে, ত্রিলোকের অধিপতি হতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন অপরাজেয় শক্তির। সেটা আবার পেতে গেলে করতে হবে তপস্যা।
ব্যস, জলন্ধর এবার দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করে অপরাজেয় হতে শুরু করে দিল সুকঠিন তপস্যা। সে এমন কঠোর তপস্যা যে, মহাদেবের মতো উদাসীনও আর স্থির থাকতে পারলেন না। ছুটে এলেন বর দিতে। বললেন, বৎস, বল তুমি কী চাও!
জলন্ধর মহাদেবের চরণে প্রণিপাত জানিয়ে করজোড়ে বলল, হে কৃপাময়, তুমি আমাকে একটাই বর দাও, যাতে ত্রিলোকে কেউ আমাকে পরাজিত করে বধ করতে না-পারেন!
মহাদেব শুনে মৃদু হেসে বললেন, হে বৎস, তুমি তো অমরত্ব প্রার্থনা করে বসেছ। দেবতা ছাড়া অমরত্বের অধিকারী আর কেউ হতে পারে না। তুমি বরং অন্য বর প্রার্থনা কর।
জলন্ধর সবিনয়ে বলল, প্রভু আমি যে কারণে আপনার শরণে এসেছি তাই-ই নিবেদন করেছি; এছাড়া আমার আর অন্য কোন প্রার্থনা নেই।
এ-কথা শুনে মহাদেব অত্যন্ত নিরুপায় হলেন। জলন্ধর যে সুকঠিন তপস্যা করেছে, তা উপেক্ষা করা যায় না, তার প্রার্থনা অপূর্ণ রাখা যায় না। তাই তিনি অমরত্বের বর দিতে বাধ্য হলেন। তবে অসীম ক্ষমতা পেয়ে দৈত্য জলন্ধরের ভবিষ্যতে যদি ‘দুর্মতি’ হয়, তাহলে তা প্রতিকারের জন্য তাতে একটি ‘কিন্তু’ রেখে দিলেন। বললেন, বেশ, তোমাকে এই বর দিচ্ছি যে, যতদিন তোমার স্ত্রী বৃন্দার চরিত্র নিষ্কলুষ থাকবে, ততদিন ত্রিলোকের কেউ যুদ্ধে পরাজিত করে তোমাকে বধ করতে পারবে না। অন্যথায় তোমার জীবন কেউ রক্ষা করতে পারবে না!
বর দিয়ে মহাদেব অন্তর্হিত হলেন। বর পেয়ে জলন্ধর খুব খুশি। কেননা, বৃন্দাকে সে সত্যিই ভালবাসত, বৃন্দাও তাঁকে ভালবেসেছিলেন। তাই কোনদিন বৃন্দা যে চরিত্রহীনতার কাজ করবেন, এটা জলন্ধর ভাবতেও পারে না। কাজেই জলন্ধর ভাবল যে, সে অপরাজেয় ও অমর হয়েই থেকে যাবে চিরটাকাল।
কথাটা ভাবতেই তপস্যায় শুদ্ধ জলন্ধরের পুনরায় আসুরিক প্রবৃত্তি জেগে উঠল অন্তরে। তীব্রতর হয়ে উঠল ত্রিলোকের অধিপতি হবার বাসনা। অমনি কোটি কোটি দৈত্য সেনা নিয়ে দৃপ্ত গৌরবে ত্রিলোক অধিকার করে ফেলল। ইন্দ্রাদি দেবতাদের বিতাড়িত করে অমরাবতী অধিকার করে স্বর্গের সিংহাসনে বসে পড়ল।
শুধু ত্রিলোকের অধিপতি হয়েই জলন্ধর ক্ষান্ত হল না। ধরাধামে মুনিঋষিদের জপতপে বাধা দিয়ে তাঁদের ওপর অত্যাচার করতে লাগল, দেবপুজো বন্ধ করে দিল, পরিবর্তে তার পুজো করতে বাধ্য করাতে লাগল। স্বর্গের প্রায় প্রতিটি লোক থেকেই দেবতাদের মেরেধরে বিতাড়িত করতে লাগল। দেবতারা তার ভয়ে ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব তুলে পাহাড়ের গোপন গুহায় গিয়ে আত্মগোপন করলেন। চরম অতিষ্ঠ সেখানেই আবাহন করলেন পরমপিতা ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মা তাঁদের প্রবোধ দিয়ে নিয়ে গেলেন ভগবান বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু তাঁদের দুরবস্থা দেখে খুব বিচলিত হলেন। অনন্ত শয্যা ছেড়ে রওনা দিলেন জলন্ধরের অন্তঃপুরের দিকে।
বৃন্দা ছিলেন সতীসাবিত্রী নারী। চরিত্ররক্ষায় সর্বদা সচেতন। তাই বিষ্ণু জলন্ধরের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন জলন্ধরের রূপ ধরে। বৃন্দা কিন্তু বিষ্ণুর এই চাতুরী ধরতে পারলেন না। বিষ্ণুর মায়ায় কামমোহিত হলেন। স্বামী ভেবে সতীত্ব হারালেন। অমনি জলন্ধরও ওদিকে হারালেন মহাদেবের বরে পাওয়া রক্ষাকবচ। আর তারপরই বিষ্ণু স্বমূর্তি ধারণ করে জলন্ধরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন।
জলন্ধর রক্ষাকবচ হারালেও সে ছিল যুদ্ধে নিপুণ বীর; তাই বিষ্ণুর সঙ্গে শুরু করল ঘোরতর যুদ্ধ। দীর্ঘ যুদ্ধের পর অবশ্য এক সময় পরাজিত হয়ে বিষ্ণুর হাতে সে প্রাণত্যাগ করল। তার বত্রিশ ক্রোশ দীর্ঘ বিরাট দেহ এসে পড়ল ধরণীর যে ভূমিতে; সেই ভূমির নাম হল ‘জলন্ধর’। আর তার মাথা যেখানে পড়ল, সেই স্থানটির নাম হল ‘জ্বালামুখী’।
জ্বালামুখী হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকার একটি বিস্তৃত জনপদ। শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দু’হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই শহর গড়ে উঠেছে ‘জ্বালামুখী’ নামের সতীপীঠকে কেন্দ্র করে।
‘পীঠনির্ণয় তন্ত্র‘ মতে একান্ন পীঠের মধ্যে পঞ্চম পীঠ হল এই জ্বালামুখী। এখানে দেবী সতীর জিহ্বা পতিত হয়েছিল। জ্বালামুখী মন্দিরে দেবীর কোন বিগ্রহ নেই, দেবী পূজিতা হন অগ্নিশিখারূপে। তন্ত্রমতে দেবীর নাম ‘অম্বিকা’, তাঁর ভৈরবের নাম, ‘উন্মত্ত’ বা ‘উন্মত্তেশ্বর’। শাক্তপীঠে দেবীকে পুজো করার পর অবশ্যই শিব-ভৈরবের পুজো দিতে হয়। এটাই নিয়ম। নইলে পুজো সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু ভৈরব উন্মত্তেশ্বর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে একটি দুর্গম গুহায় অবস্থান করেন। সেই গুহা সাধারণের জন্য অগম্য। তাই মন্দিরে যে ‘নর্মদেশ্বর’ শিব রয়েছেন, তাঁকে পুজোর মধ্য দিয়েই উন্মত্তেশ্বরকে ভজনা করা হয়।
দেবীরূপে যে অগ্নিশিখাটি পুজো করা হয়, তার আকার প্রায় এক ফুটের মতো। মন্দিরের উত্তরদিকের দেওয়ালে প্রাকৃতিকভাবে একটি পাথরের ফাটল থেকে শিখাটি প্রজ্জ্বলিত হয়ে রয়েছে। কেউ সঠিক জানেন না এই শিখা কবে থেকে জ্বলছে, কেউ অনুমান করেন হাজার বছর ধরে জ্বলছে, কেউ বা বলেন দু’হাজার বছর ধরে জ্বলার কথা। কিন্তু সকলেই জানেন যে, এই শিখা কখনই নেভে না।
শোনা যায়, সম্রাট আকবর নাকি একবার পাহাড়ের ঝর্ণার ধারা বইয়ে এই শিখা নেভানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হয়ে দেবীর শরণ নেন। শিখার ওপরে তিনি একটি সোনার ছাতা নির্মাণ করে আপন ভক্তির নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেন। কিন্তু কালক্রমে অনির্বাণ অগ্নিশিখায় সেই ছাতা নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীকালে অগ্নিশিখার সামনে একটি রূপোর সিংহাসন স্থাপন করা হয়েছে, দেখে মনে হয় শিখারূপী দেবী তাতে বিরাজ করছেন।
দীর্ঘ অগ্নিশিখা ছাড়াও মন্দিরে ছোট ছোট শিখার আরও ছটি অগ্নিশিখা দেখা যায়। মোট এই সাতটি শিখাকে দেবী শক্তির সাতটি রূপ হিসেবে কল্পনা করা হয়। তাঁদের রয়েছে আলাদা আলাদা নাম, জথা—‘কালী’, ‘করালী’, ‘মনোজবা’, ‘সুলোহিতা’, ‘সুধূম্রবর্ণা’, ‘স্ফূলিঙ্গিনী’ ও ‘বিশ্বরূপা’। মাঝে মাঝে আরও দুটি বাড়তি অগ্নিশিখা দেখা যায়। তখন মন্দিরে প্রজ্জ্বলিত হয় মোট ন’টি শিখা। এই মোট ন’টি শিখাকে আবার অনেকেই ভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন। যেমন—‘মহাকালী’, ‘অন্নপূর্ণা’, ‘চণ্ডী’, ‘হিংলাজমাতা’, ‘বিন্ধ্যবাসিনী’, ‘মহালক্ষ্মী’, ‘সরস্বতী’, ‘অম্বিকা’ ও ‘অঞ্জিদেবী’। তবে শাস্ত্রমতে দেবীকে যে-নামেই ডাকা হোক না কেন, সাধারণের কাছে দেবী ‘সিদ্ধিদা’, ‘জ্বালাদেবী’ ও ‘লণ্ঠনওয়ালী মাঈ’ নামেই প্রিয়।
দেবীর আত্মপ্রকাশের একটি কিংবদন্তি রয়েছে। এবার সেটাই বলিঃ
আসলে, অন্যান্য সতীপীঠের মতোই এই সতীপীঠও বহুদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। দুর্গম পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিতির জন্য তা যখন কিছুতেই সাধারণের কাছে প্রকাশিত হল না, তখন দেবী স্বয়ং কাংড়ার রাজা ভূমিচন্দ্রকে স্বপ্ন দিলেন যে, তাঁর জিহ্বা নিকট পাহাড়ের উপত্যকায় ভক্তের পূজার আকাঙ্ক্ষায় অধীর, তাকে যেন রাজা দেবীরূপে প্রতিষ্ঠা দিয়ে তীর্থ করে তোলেন।
দেবীর আদেশ পেয়ে রাজা শুরু করলেন অনুসন্ধান। কিন্তু কোথাও আর দেবীর জিহ্বা-চিহ্ন খুঁজে পান না। তাঁর খোঁজের কথা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত জনপদে। সমস্ত অঞ্চল খুঁজে যখন রাজা হয়রান, তখন দেবী শিখারূপে কয়েকজন সহজ-সরল রাখাল বালককে দর্শন দিলেন। তেল ছাড়া, সলতে ছাড়া অমন শিখা হঠাৎ আবির্ভূত হতে দেখে, তারা ভয় পেয়ে হতবাক হয়ে যায়। দূরে রাজার লোকেদের ছুটতে ছুটতে গিয়ে খবর দেয়। খবর পেয়ে রাজা আসেন। শিখা দেখে তিনি দেবীকে চিনতে পারেন। বৈদিক যজ্ঞে বেদির অগ্নিশিখাকেই জিহ্বারূপে কল্পনা করা হয়, তাতেই হবি অর্পিত হয়। অগ্নিময় জিহ্বাতে হবি গ্রহণ করে যজ্ঞদেবতা তুষ্ট হন ও যজ্ঞফল দান করেন। কাজেই রাজা বোঝেন যে, অনির্বাণ এই অগ্নিশিখাই দেবীর জিহ্বা। তখন সেখানেই তিনি দেবীর মন্দির নির্মাণ করে দেন, ব্রাহ্মণ আনিয়ে দেবীর পুজোর ব্যবস্থা করেন।
পাহাড়ের উপর নির্মিত দেবীর মন্দির স্ফটিক পাথরে নির্মিত। গর্ভগৃহটির প্রবেশ-দরজা রয়েছে দক্ষিণ দিকে। রুপোর এই দরজা নির্মাণ করিয়ে দেন পাঞ্জাব কেশরী রঞ্জিত সিংহের পুত্র খড়গ সিং। এই দরজা ভাঁজ করে খোলা যায়। মন্দিরে মাথায় রয়েছে গম্বুজ আকারের চূড়া এবং তা সোনায় মোড়া। দুপুরের এক ঘন্টা আরতির সময় ছাড়া, চব্বিশ ঘণ্টা দর্শনার্থীদের জন্য মন্দির খোলা থাকে। দুধ, রাবড়ি, প্যাঁড়া, মিছরি, ফল প্রভৃতি নৈবেদ্য নিবেদন করে পুজো করা হয়। নবরাত্রি ও শিবারাত্রিতে এই মন্দিরে বিরাট উৎসব হয়, মেলা বসে; হয় দারুণ ভক্ত সমাগম। প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে ‘জয় সিদ্ধিদা মাতার জয়’ , ‘জয় অম্বিকা মাতার জয়’ ধ্বনিতে; ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়-অরণ্যময় সমস্ত চরাচরে। আর এই দেবীনাম ভক্তিপুলকে শিহরণ জাগিয়ে যায় সমস্ত ভক্তের অন্তরে, উপলব্ধি করায় এক অপার্থিব আনন্দ। এরই নাম বোধহয় ‘লীলা’...