চিঠির খামে জয়নগরের মোয়া

ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, 'শীত কাল কবে আসবে সুপর্ণা?' কখনও প্রশ্ন করেছেন বাংলায় শীত আসে কী করে? সত্যজিৎ পথের পাঁচালীতে দেখিয়েছেন কী করে বর্ষা আসে বাংলায়। গরম তো হাড়ে হাড়ে টের পান। দুগ্গা পুজোর দৌলতে শরৎও দিব্যি বোঝা যায়।

 

তাহলে শীত? ঠান্ডা পড়লে? না! কেবল ঠান্ডা আর সোয়েটারে নয়। শীত আসে পরীক্ষা শেষের স্কুল ছুটি, কমলালেবু, চিড়িয়াখানা, কেক, দুপুরের রোদ পোহানো, পিঠ-পুলিতে! তবে আরেকটা জিনিস না হলেই নয়। সে না আসলে শীত এসেও আসে না। হয়ত মুখভার করে উত্তরে হাওয়া।

 

তিনি হলেন খাঁটি জয়নগরের জিনিস। দক্ষিণ ২৪ পরগনা তথা গোটা বাংলার প্রাইড। সীতাভোগ মিহিদানার পর এবার সেও চলে এল আমাদের ডাকবিভাগে। মিলল জাতীয় স্বীকৃতি। কিন্তু কীভাবে? জানতে হলে আগে জয়নগরের মোয়ার রূপকথার গপ্পো জানতে হয়। বাঙালির শীতকালের আমেজ অসম্পূর্ণ থেকে যায় জয়নগরের মোয়ার অভাবে।

JoynagarMoya1

দক্ষিন ২৪ পরগনার জয়নগর, শুধু শীতকালেই কয়েককোটি টাকার ব্যবসা করে এই মোয়াকে কেন্দ্র করে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই মোয়ার আবিস্কারক হলেন জয়নগরের নিকটবর্তী বহুড়ু গ্রামের জনৈক যামিনী বুড়ো। একটি অনুষ্ঠানে তিনি নিজের খেতে উৎপাদিত কনকচূড় ধানের খইনলেন গুড় দিয়ে মোয়া প্রস্তুত করে পরিবেশন করেছিলেন। এরপরে মোয়ার জয়যাত্রা শুরু, আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমে এই মোয়া জয়নগর শহর এবং ধীরে ধীরে আজ গোটা বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই তখন থেকেই ব্যবসায়িক ভিত্তিতে মোয়া তৈরী হতে শুরু হয়। ১৯২৯ সালে পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকি বাবু এবং নিত্যগোপাল সরকার জয়নগরে প্রথম মোয়া তৈরীর কারখানা দোকান স্থাপন করেন।

 

এই মোয়ার প্রধান উপাদান হল দক্ষিন ২৪ পরগনার কুলপি, কাকদ্বীপ ও নামখানায় চাষ হওয়া কনকচূড় ধানের খই, খাঁটি নলেন গুড়, গাওয়া ঘি। এছাড়াও ক্ষীর, কাজু, কিসমিস ও পেস্তা, এখন সবই যোগ করা হয়। ২০১৫ সালের ১৩ই মার্চ জয়নগর মোয়ার ভৌগলিক স্বত্ব পায়।

 

তবে মোয়া শিল্পের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হল, এখন আসল নকল সব মোয়া মিলে মিশে একাকার। সাধারণ লোকাল ট্রেন থেকে স্টেশনের বাইরের দোকানে বা বড় বড় করে লেখা জয়নগরের মিষ্টির দোকানে, যেকোন জায়গাতেই মোয়ার দেখা মেলে, কিন্তু খাঁটি জয়নগরের মোয়া পাওয়া যায় না। আসল মোয়া চেনা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে এটুকুই বলা যায় প্রকৃত জয়নগরের মোয়া খুবই নরম হয়।

JoynagarMoya2

প্রতি বছর শীতে জয়নগরের কয়েক হাজার লোক, শ-চারেক দোকান এই মোয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে রুজিরুটির জন্য। হাল আমলে নানা রকম মোয়া তৈরি হচ্ছে জয়নগরে, ২০১৯-এ জয়নগরে চকোলেট মোয়ার আবির্ভাব হয়েছে। তবে এই মোয়া নিয়ে দুটো ডিবেট রয়েছে বাংলায়। প্রথমত, অনেকেই বলেন মোয়ার জন্ম বহুড়ু গ্রামে কিন্তু নেপোয় দই মারার মতো করেই, এর খ্যাতি ছিনিয়ে নিয়েছে জয়নগর। এ বিতর্ক চলবেই! তবে, এইটুকু বলা যায় মোয়ার ভৌগোলিক স্বত্ত্ব কিন্তু জয়নগরই পেয়েছে।

 

দ্বিতীয় বিতর্ক অবশ্য এর এক উপাদানের নাম নিয়ে। যা ছাড়া মোয়া তৈরি এক্কেবারে অসম্ভব, তা হল নলেন গুড়। এক সময়ের বাংলা নাম ছিল গৌড়। এই গৌড় শব্দটি খুব সম্ভবত গুড় থেকে এসেছে। তাল, খেজুর ইত্যাদি দিয়ে গুড় তৈরি হয়। তবে মিষ্টির রাজ্যে যে গুড়ের নিত্য যাতায়াত এবং বাঙালির পাতেও যার আবাধ প্রবেশ তা হল খেজুরের গুড় বা নলেন গুড়। যেহেতু এই গুড় বছরে একবার, প্রত্যেক শীতে নতুন করে ওঠে, তাই অনেকে মনে করেন নলেন শব্দের অর্থ হল নতুন।

 

এক অংশের মানুষ মনে করেন নলেন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। আবার একদল বলেন, নলেন কথাটির জন্ম হয়েছে ‘নরকু’ অথবা ‘নরক্কু’ থেকে যা দ্রাবিড়ীয় ভাষার শব্দ। অভিধানে এর অর্থ হল ছেদন করা বা কাটা। খেজুর গাছ কেটে ছেঁচে তারপর ফুঁটো করে দিলেই খেজুরের রস বেরোতে শুরু করে। একটি বাঁশের ছিলাহাঁড়ি সেখানে বেধে দেওয়া হয় যাতে রস ক্রমশঃ চুয়ে চুয়ে ঐ হাড়িতে এসে জমা হতে পারে।

JoynagarMoya3

তাই মনে করা হয়, নড়কু শব্দ থেকে নলেন শব্দের জন্ম হয়েছে। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধান মতে, নরুন বা নরশনি মানেও ছেদন করা বা কাটা। এক্ষেত্রে, নরুন হল গ্রামের নাপিতের ক্ষৌর অস্ত্র, গ্রাম বাংলায় যা অনেক সময়ই খেজুর গাছ ফুঁটো করতে ব্যবহৃত হয়। সংগৃহীত রস জ্বাল দিয়ে প্রস্তুত করা হয় নলেন গুড়। এই রস সংগ্রহের পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের বলা হয় ‘শিউলি’। মিষ্টির সঙ্গে নলেন গুড় যোগ করে স্বাদের মাত্রা কয়েক গুন রাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই শীতকালে বাংলার মিষ্টির দোকানগুলি সেজে ওঠে লালচে গুড়ের রসগোল্লায় ও সন্দেশে, সেই গুড়ই হল মোয়ার অন্যতম আবশ্যক উপাদান।

 

বাঙালি চিঁড়ের মোয়া, মুড়ির মোয়া সারাবছর খেলেও; তার সবচেয়ে প্ৰিয় মোয়া হল জয়নগরের মোয়া। এবার বারুইপুরের প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের ডাকবিভাগ এই জয়নগরের মোয়াকেই নিয়ে এল ভারতীয় ডাকবিভাগের অন্দরে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর, জয়নগরের মোয়ার ছবি ও তথ্য সম্বলিত এক বিশেষ খাম বা কাভার প্রকাশ করেছেন তাঁরা। যার মূল্য রাখা হয়েছে ২০ টাকা। এবার থেকে সর্বত্রই মিলবে এই খাম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...