'কিশলয়' নামে সরকারি স্কুলপাঠ্য একটি বই ছিল একসময়। তাতে প্রথম শ্রেণিতে 'অ' শেখাতে গিয়ে বলা হত অজয় নদের কথা, ঘোষানো হত দু'চরণের ছড়া:
'অজয় নদে এলো বান।
জলে ভাসে সোনার ধান।।'
ছড়াটি ঘুষতে ঘুষতে বর্ষাভরা অজয়ের এক ভয়ঙ্কর-সুন্দর রূপ কল্পনালোকে ফুটে উঠত। অজয়ের নাম এভাবেই প্রথম শোনা। তারপর ক্রমে ক্রমে তার সঙ্গে আলাপ।
সেই সময় পৌষ-সংক্রান্তির আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ভাড়া করা বাস ছাড়ত (এখনও অবশ্য একইরকমভাবে ছাড়ে)। তাতে নারী-পুরুষের ভিড় চড়ত। বেড়ে ওঠার পথে মনে প্রশ্ন জাগত, 'ওরা কোথায় যাচ্ছে?'
'জয়দেব', উত্তর আসত।
'জয়দেব কোথায়?' আবার প্রশ্ন।
'অজয় নদের ধারে।'
'সেখানে কী হয়?'
'মকরে চান করলে পুণ্য হয়।'
'কেন পুণ্য হয়?'...
এভাবেই আগ্রহের ক্রমাগত তাপ্পিতে ওই সব ছেঁড়া ছেঁড়া কথা বাউলের আলখাল্লার মতো একদা পূর্ণতা পায়। জানা যায়, এপার-ওপার বিস্তৃত অজয় বর্ষায় যা-ই হোক না কেন, পৌষে মোটেই ভয়ঙ্কর নয়। বরং অপার সৌন্দর্য নিয়ে সে তখন লালিমামাখা ধূ ধূ বালুচর ঘেঁষে কুলুকুলু রবে আপন ছন্দে বয়ে যাওয়া এক নিরীহ নদ। যে, সকাল-সন্ধে সূর্যের আভায় রাঙা হয়; সারাদিন শুদ্ধ সমীরণে প্রাণজুড়ে স্নিগ্ধতা বিলোয়।
অজয়ের তীরেই জয়দেব। না, জয়দেব কোন স্থানের নাম নয়। স্থানটি গ্রাম। আর সেই গ্রামের নাম 'কেন্দুবিল্ব'; লোকমুখে, 'কেন্দুলি'। ভালোবাসার নাম, 'জয়দেব'। কেননা, কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই গ্রামেই ভক্তকবি জয়দেবের জন্ম।
কারও কারও মতে অবশ্য জয়দেবের জন্ম সাবেক উৎকলে। সেখান থেকে পরে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন।
আবার অনেকের মতে, বাংলার কেন্দুবিল্ব গ্রামের সঙ্গে জয়দেবের কোন সম্পর্কই নেই। তাঁরা তথ্যসহ প্রমাণ করেছেন যে, জয়দেব ওড়িয়া। বাংলায় কখনই আসেননি। পুরী থেকে খানিক দূরে প্রাচী নদীর তীরে যে কেন্দুবিল্ব বা কেন্দুলি শাসন গ্রামটি এখনও রয়েছে, সেখানেই তাঁর জন্ম। তাতে অবশ্য জন্মস্থান-বিতর্ক শেষ হয়ে যায়নি; তাঁদের 'প্রমাণ' বেশিরভাগ পণ্ডিতই মেনে নিয়েছেন, অনেকেই মানেননি। তবে ডঃ সুকুমার সেনের মতো বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক প্রথম দিকে বিরোধ করলেও পরে এই মতটিকেই যুক্তিযুক্ত বুঝে মেনে নিয়েছেন।
যাই হোক, আপামর বাঙালি কিন্তু বাংলার কিংবদন্তিটিকেই সত্য বলে বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেন, বীরভূমের কেন্দুলির মাটিতেই জয়দেবের জন্ম। এখানে বসেই তিনি রাধাকৃষ্ণের অপূর্ব মিলনগাথা 'শ্রীগীতগোবিন্দম' রচনা করেন। তিনি ছিলেন বাংলার বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি। তাঁর পঞ্চরত্নের এক রত্ন।
কিংবদন্তির প্রেক্ষাপট দ্বাদশ শতক। সেই সময় পরম বৈষ্ণব জয়দেব পত্নী পদ্মাবতীকে নিয়ে এই কেন্দুলি গ্রামেই সাধন-ভজন করতেন। অজয়ের ফুলেশ্বর ঘাটের কাছে এখনও আছে জয়দেবের সিদ্ধাসন। এখানে বসেই নাকি পূর্ণতা পায়, তাঁর 'শ্রীগীতগোবিন্দম' কাব্য।
কাব্যটি রচনা-প্রসঙ্গেও আছে এক কিংবদন্তি। সেটি হল:
কাব্যটি লিখতে লিখতে এক জায়গায় এসে আটকে গেলেন জয়দেব। মানময়ী রাধার মানভঞ্জন করবেন কৃষ্ণ। সবটুকু দিয়ে নিজেকে সমর্পণ করবেন রাধার কাছে; কিন্তু, কীভাবে সেটা করবেন, সেই সকাল থেকে লিখতে বসে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না জয়দেব। নিছক বেলা বাড়ছিল, মধ্যাহ্ন ভোজনের কাল অতিক্রান্ত হচ্ছিল; তাই হাল ছেড়ে একসময় তিনি নদীতে স্নান করতে গেলেন।
অন্যদিনের চেয়ে অত্যন্ত অল্প সময়েই স্নান সেরে ফিরলেন জয়দেব। ভেজা কাপড় ছেড়েই বসে পড়লেন কাব্যের হাল-ছাড়া অংশটি লিখে ফেলতে; সৃষ্টির আবেশ যেন তাঁকে অনন্য তাগিদে টেনে এনে বসাল লেখার আসনে। অধরা ভাবনা শব্দমালার সুতোয় যেন এবার ধরা দিয়েছে। এমন আবেশে অল্পক্ষণেই লেখাটি সম্পন্ন করে যেন শান্তি পেলেন জয়দেব। এতক্ষণে যেন অনুভব করলেন জঠরের জ্বালা; পদ্মাবতীকে বললেন ভাত বাড়তে।
পদ্মাবতী দাওয়ায় আসন পাতলেন। পরম যত্নে ভাত বেড়ে দিলেন। জয়দেব তখন আয়েশ করে বসে খেতে শুরু করলেন। পদ্মাবতী সেই সময়টুকু তালপাতার পাখায় বাতাস করলেন, পদ-ব্যঞ্জন এগিয়ে দিলেন। জয়দেব তৃপ্ত হলেন। তারপর মুখশুদ্ধি মুখে নিয়ে দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের জন্য গেলেন শয্যাগৃহে।
তখন এঁটো পাতটিতে ভাত বেড়ে খেতে বসলেন পদ্মাবতী। সবে একগ্রাস অন্ন মুখে তুলেছেন, অমনি জয়দেবকে দেখলেন উঠোনে। স্নান সেরে সবে ফিরছেন! দেখে, পদ্মাবতীর মুখের গ্রাস মুখেই রইল, একেবারে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন! এ কী করে সম্ভব!
জয়দেবও তাঁর আগে পদ্মাবতীকে খেতে বসতে দেখে অবাক! বেশ রাগ হল। উষ্মা নিয়ে বললেন, এ কী পদ্মা, এ কী অনাচার! আমায় অভুক্ত রেখে নিজে আহার করছ!...
জয়দেব হয়তো আরও কটুকথা বলতেন, কিন্তু পদ্মাবতী গলায় আটকে থাকা খাবারটুকু অতিকষ্টে গিলে হতভম্বের মতো বললেন, আমিই বা এ কী দেখছি স্বামী! আপনি তো খানিক আগেই স্নান সেরে এলেন, কাব্য লিখলেন, খেলেন, শয্যাঘরে গেলেন; তাহলে এখন আপনি আবার...
পদ্মাবতীর মুখ দেখে জয়দেব স্পষ্ট বুঝলেন কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। তিনি প্রায় ছুটে গেলেন শয্যাঘরে, না, কেউ নেই। ছুটে এলেন পুঁথি-লেখার আসনে, অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, তিনি যেখানে আটকে গিয়েছিলেন, সেখানে উজ্জ্বল আখরে লেখা:
'স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং দেহি পদপল্লবমুদারম।'
এর অর্থ, মান ভাঙাতে প্রিয় রাধার পদপল্লব মাথায় ধারণ করতে চাইছেন কৃষ্ণ!
প্রিয়কে মাথায় করে রাখা, নিজের চেয়েও তাঁকে মহৎ করা, প্রেমকে পূজার মর্যাদা দেওয়া--এর চেয়ে বড় সমর্পণ আর কীসে হয়! এমন অহংত্যাগী সমর্পণই তো চাইছিলেন জয়দেব।
চাইলেও, জয়দেব অত্যন্ত দ্বিধায় ছিলেন শ্রীকৃষ্ণকে দিয়ে রাধার চরণ ধারণ করাবেন কি না, তাই নিয়ে। দ্বিধা ছিল বলেই সুললিত শব্দের আদলে ভাবনা ধরা দিচ্ছিল না। বুঝলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ জয়দেবের রূপ ধরে এসে সেই দ্বিধা দূর করে গেলেন, কাব্যের পংক্তিপূরণ করে গেলেন, প্রিয় পদ্মাবতী ও জয়দেবকে কৃপা করে গেলেন। তাঁর লীলা অনুধাবন করে জয়দেবের চোখেও জল এসে গেল। তিনি গদগদ হয়ে ইষ্টের উদ্দেশ্যে পরম ভক্তিতে বার বার প্রণিপাত করতে লাগলেন...
এভাবে শুধু একবার নয়, বার বার জয়দেব পেয়েছিলেন ঐশ্বরিক কৃপা। কদমখণ্ডির ঘাট থেকে স্বপ্নযোগে লাভ করেছিলেন তাঁর ইষ্ট, রাধাবিনোদকে। তাঁকে গৃহেই প্রতিষ্ঠা করে তিনি সারাজীবন পুজো করেছেন। অবশ্য অনেক পরবর্তীকালে, ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বর্ধমানের রানি জয়দেবের ভগ্ন ভিটের ওপর তৈরি করিয়ে সেখানে রাধাবিনোদকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে মন্দিরটিই কেন্দুলির একমাত্র আকর্ষণ। নবরত্ন মন্দির। তাতে টেরাকোটার অপূর্ব সুষমায় চিত্রিত রয়েছে পুরাণের বিভিন্ন কাহিনি। হয়ে রয়েছে অঢেল সৌন্দর্যের আকর।
যাই হোক, ফের ফিরে আসি জয়দেব সম্পর্কিত কিংবদন্তির কথায়। শোনা যায়, জয়দেব নাকি প্রতি বছর মকর-সংক্রান্তিতে দীর্ঘ পথ হেঁটে পুণ্যবাহিনী গঙ্গায় স্নান করতে যেতেন। তাতে ভক্তশ্রেষ্ঠ জয়দেব আর মা গঙ্গা উভয়েই ধন্য হতেন। কিন্তু একবার পৌষ-সংক্রান্তির আগে জয়দেব বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অতটা পথ হেঁটে গঙ্গাস্নানে যাবার সামর্থ্য তাঁর রইল না। কিন্তু মন কী আর মানে! প্রাণ আকুল হল। অসহায় ভক্তের চোখে জল এল। বেরিয়ে এল আকুতি, মা গো, নাচার হয়েছি বলে এ-বার কী তোমার দেখা পাবো না? তোমার কৃপা পাবো না?
ভক্তের এই আকুলতা মা গঙ্গাকেও ব্যাকুল করল। তিনি জয়দেবকে স্বপ্ন দিলেন। বললেন, দুঃখ করো না বাছা। ভক্ত ছাড়া ভগবান-ভগবতী সকলেই অসম্পূর্ণ, তুমি তো তা জানোই। তুমি আমার কাছে আসতে পারোনি তো কী হয়েছে, আমিই যাব তোমার কাছে। পৌষ-সংক্রান্তির প্রভাতে অজয়ের ধারায় আমি প্রবাহিত হব। প্রবাহে কদম্বখণ্ডির ঘাটে পদ্ম দেখলেই বুঝবে, আমি তোমার কাছে হাজির হয়েছি...।
সংক্রান্তির ভোরে স্বপ্নভঙ্গ হল জয়দেবের। বুঝলেন, এ তো স্বপ্ন নয় শুধু, এ যে দেবীর আদর, দেবীর আদেশ। অমনি জয়দেব অধীর আগ্রহ নিয়ে হাজির হলেন কদম্বখণ্ডির ঘাটে। তারপর যখন দিগন্তে ঊষা উদিত হচ্ছেন, ঠিক তখনই ঘাটে পদ্ম ভেসে আসতে দেখলেন জয়দেব। অমনি তাঁর মুখে ফুটল কৃপালাভের প্রসন্নতা। চোখে এল অনাবিল বারি। ভক্তিভরে গঙ্গা মাকে প্রণতি জানিয়ে নামলেন ঘাটে। অবগাহন করে ধন্য হলেন। এই হল শুরু। এরপর যতদিন জয়দেব জীবিত ছিলেন, প্রতি বছর দেবী গঙ্গা নিয়ম করে মকর সংক্রান্তিতে অজয়ের ধারায় প্রবাহিত হতে লাগলেন। রচিত হল, ভক্ত ও ভগবতীর অপূর্ব মিলনগাথা।
কিংবদন্তির এই সূত্রটি স্মরণ করেই আজও মকর-সংক্রান্তিতে রাজ্য তো বটেই, দেশের নানান প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থী মানুষ কেন্দুলিতে ছুটে আসেন অজয়ের ধারায় স্নান করে পুণ্য অর্জন করতে। তারপর ভক্তশ্রেষ্ঠ জয়দেবের স্মৃতিধন্য রাধাবিনোদের মন্দির, সিদ্ধপীঠ, কুশেশ্বর শিব মন্দির দর্শন করে পুজো দিয়ে ধন্য হন।
মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে নদী অব্দি বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সেই উপলক্ষে বসে যায় দারুণ জমজমাট মেলা। মেলাটি কয়েকশো বছরের প্রাচীন। মকর-সংক্রান্তিতে শুরু হয়ে চলে দিন পনের ধরে। কোভিডের জন্য দিনের গুনতি এবার কমেছে। হরেক খাবার, মনোহারি জিনিসের দোকান, হস্তশিল্পের ভাণ্ডার, সবস্ত্র ও নাগা সন্ন্যাসীদের জমায়েত, অজস্র অগুন্তি পুণ্যার্থী মানুষের ভিড়-একটা বৃহৎ মেলা তীর্থের চেহারা নিলে স্বরূপ যেমন হয়, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই।
তবে এই মেলার মূল আকর্ষণ এসব নয়। ভক্তকবির দেশে এ-মেলার মূল আকর্ষণ বৈষ্ণবভক্ত ও আউল-বাউলদের অস্থায়ী আখড়া। আখড়ায় রাত্রিব্যাপী কীর্তন আর বাউলগানের আসর। তাঁদের সুমধুর সৃজনশীলতার মাঝে রাত্রিযাপন এক অন্য অনুভূতির জন্ম দেয়। সেখানে সকলের সঙ্গে পংক্তিভোজনে পাওয়া যায় আপমরে মিলে যাওয়ার সুকৃতি। মিলনের এই মেলা পুণ্যের লোভে টানে, অন্তর শুদ্ধ করে ঘরে ফেরায়; আর নিজে রয়ে যায় আজীবন মোহিনী হয়ে...