জয়নগরের জয়চণ্ডী মন্দির, নিরাকার দেবী হয়ে উঠলেন সাকার; কিশোরীবেশী দেবী

কনকচূড় ধানের খইয়ে নলেন গুড়ের পাক পড়লে মোয়া তৈরি হয়, বাঙালির শীতকালের এই অবিচ্ছেদ্য উপাদানটির জন্যেই জয়নগরের খ্যাতি। তবে ঈশ্বর, ভক্তি আর ভক্তিবাদ নিয়েও জয়নগর পিছিয়ে নেই। এক সময় আদি গঙ্গা এখন থেকেই প্রবাহিত ছিল। শ্রীচৈতন্যদেব আদিগঙ্গার তীর ধরে চক্রতীর্থ ভ্রমণ করে জয়নগর হয়ে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে গমন করেন। ইতিহাস প্রসিদ্ধ জয়নগরের দেবী হলেন জয়চণ্ডী। গবেষকদের কেউ কেউ বলেন, দেবীর নামেই জয়নগর নামটির বুৎপত্তি।

জয়নগরের রাজা নীলকণ্ঠ মতিলাল, করদ রাজ্যের নরপতি হিসেবে রাজা সুবুদ্ধিরায়ের রায়নগর রাজ্য তথা রায়মঙ্গল, সূর্যপুর এবং সরস্বতী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার কিছু অংশ শাসন করতেন। এক হাজার এক সালে যখন সমগ্র জয়নগর ভেসে যায়, রায়নগর রাজ্যের অধিকাংশ জনমানবহীন হয়ে পড়ে। নীলকণ্ঠ মতিলাল মগধের যুদ্ধে প্রাণ হারালে তার ভাই সপরিবারে যশোরে চলে যান, কিন্তু কয়েক পুরুষ পরেই ওই বংশের সন্তান গুনানন্দ মতিলাল পৈতৃক সম্পত্তি ও কুলদেবী জয়চণ্ডী দেবীকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে মন্দির ছিল খড়ের চলের কুড়ে ঘরে। উদ্ধার করা সেই মূর্তির পাশে দারু নির্মিত নতুন মূর্তি তৈরি করা হয়। প্রায় ১০২২ বছর যাবৎ দেবী পূজিত হয়ে আসছেন। মনে করা হয় জৈষ্ঠ্য মাসের পূর্ণিমায় দেবী আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই শুক্ল প্রতিপদ থেকে প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে এক পক্ষকাল জুড়ে দেবীর রূপপরিবর্তনের মেলা ও পুজো হয়ে আসছে।

মন্দির প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে আরও এক কিংবদন্তি শোনা যায়। আজ থেকে ছয় শতক আগের কথা। ছয়শত বছর আগে জয়নগর আজকের মতো ছিল। সেখানে এক গরিব ব্রাহ্মণ বাস করতেন।

একদিন গভীর রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন নিকটবর্তী পুকুরের জলে এক দিব্য জ্যোতির্ময়ী দেবী ভেসে বেড়াচ্ছেন। তৎক্ষণাৎ ঘুম ভেঙে যায় ব্রাহ্মণের। তিনি ছুটে যান পুকুরের দিকে। ভোরবেলা পুকুরের মধ্যে থেকে উদ্ধার করেন এক দিব্য শিলাখন্ড। দেবী চণ্ডী পুনরায় ব্রাহ্মণকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন এবং নির্দিষ্ট এক বকুল গাছের তলায় ওই শিলাখণ্ডকে প্রতিষ্ঠা করে, পুজো করার নির্দেশ দেন। ওই স্থানেই মন্দির নির্মিত হয় এবং দেবী ওই বকুল বৃক্ষ দিয়েই বিগ্রহ নির্মাণের আদেশ দেন। প্রতিষ্ঠিতা হন শ্রীশ্রী দেবী জয়চণ্ডী। বর্তমান মন্দিরটির বয়স প্রায় পাঁচশোর বছরেরও বেশি। আজও মন্দিরের সেই বকুল বৃক্ষ নির্মিত দেবীর দারুবিগ্রহ বিরাজমান। স্বপ্নাদেশে পাওয়া শিলাখণ্ডটিও দারুবিগ্রহের সঙ্গে পূজিত হচ্ছে। এলকবাসীর বিশ্বাস দেবী জয়চণ্ডী অত্যন্ত জাগ্রত। শোনা যায়, আজও নাকি দেবী প্রতি রাতে ভ্রমণে বের হন। কেউ কেউ তা দেখেছেন বলেও দাবি করেন।

বর্তমান মন্দিরটি দক্ষিণমুখী, যা ১৯৫০ সালে মহেন্দ্র শ্রীমানি নির্মাণ করেছিলেন। নাটমন্দিরটি নির্মাণ করেন নিত্যহরি মতিলাল। গর্ভমন্দিরে সিমেন্টের বেদিতে কাঠের মঞ্চের উপর বকুল কাঠ নির্মিত দেবী মূর্তি বিরাজ করেন। দেবী বিগ্রহের উচ্চতা আড়াই ফুট উঁচু। শাড়ি পরিহিত দেবী, গৌরবর্ণা ত্রিনয়নী। দেবীর হাত দুটি অলঙ্কার শোভিত, অভয় ও বরাভয় দান করে। দেবীর মাথায় রয়েছে মুকুট। দেবী এক কিশোরী বেশি।

মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শ্রীশ্রী জয়চণ্ডীর আবির্ভাব নিয়ে কিংবদন্তির শেষ নেই। শোনা যায়, গুণানন্দ ও জৈনক টুনুপণ্ডিত একদিন নৌকা করে আদিগঙ্গা দিয়ে যাওয়ার সময় নদীর তীরে এক সুন্দরী রমণীকে একাকী বিচরণ করতে দেখেন। তাঁরা নৌকা থেকে তীরে নামার পর ওই রমণীকে আর দেখতে পেলেন না। সেইনরাতেই গুণানন্দ স্বপ্নাদেশে জানতে পারেন যে, ওই রমণী হলেন শ্রীশ্রী জয়চণ্ডী। স্বপ্নাদেশে দেবী মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে পুজোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।

মন্দিরটি অলৌকিক ঘটনার আকর। মন্দিরের সামনে একটি কদম গাছ রয়েছে। ওই গাছে একটি মাত্র ফুল ফোটে, তাও আবার এই জৈষ্ঠ্য মাসেই। ফুলটি গভীর রাতে দেখা যায়, তা দিয়ে মার পূজা হয়। জগন্নাথদেবের স্নান যাত্রা থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়চণ্ডী দেবীর ১৫ দিন ব্যাপী বাৎসরিক পুজো, উৎসব ও মেলা হয়। এটিই দেবীর আবির্ভাবের মাসে। সময় বেশের মেলা হয়ে থাকে। এক পক্ষ জুড়ে পনেরো দিন, দেবীর পনেরোটি বেশের পুজো হয়।

দেবী পনেরোটি বেশ হল, ইন্দ্রানী, কমলে কামিনী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, ব্রাহ্মণী, রাইরাজা, দেবী মনসা, বিপত্তারিনী, গনেশ জননী, জগদ্ধাত্রী, জাহ্নবী, অন্নপূর্ণা, শ্রীলক্ষ্মী, মা শীতলা, কাত্যায়নী, রাজরাজেশ্বরী। প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা অবধি এই রূপগুলোয় বিরাজ করবেন দেবী। এর মধ্যে রাজরাজেশ্বরী রূপটি তিনদিন থাকবে।

এ প্রসঙ্গে বলি, বেহালায় ৪০০ বছর পুরনো জয়চণ্ডী ঠাকুরানি মন্দির রয়েছে। যা কলকাতার অন্যতম প্রাচীন মন্দির হিসেবে তা বিবেচিত হয়। কথিত আছে, একসময় এই মন্দিরের পাশ দিয়ে আদিগঙ্গা বয়ে যেত। মনসামঙ্গল কাব্যে এর উল্লেখ রয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত, এই মন্দিরের পাশ দিয়েই বেহুলা ভেলায় করে লখিন্দরকে নিয়ে গিয়েছিলেন। শোনা যায়, এরপর থেকেই স্ত্রীরা এই মন্দিরে স্বামীদের মঙ্গল কামনায় পুজো দিলেই পূরন হয় মনস্কামনা। মন্দিরে প্রতিদিন বহু ভক্তর সমাগম হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...