বাঙালির প্রেমের নতুন ভাষা তৈরি করেছেন তিনি। সে প্রেম ভারী ভিতু। ভারী মধ্যবিত্ত। একা গলির রাস্তায় হেঁটে যায় বিষাদ ডোবা মন নিয়ে। আর ব্যাকুল হৃদি ডুব দেয় অনন্ত বিরহের অলকানন্দায়। স্কুল শেষ করা কিশোর থেকে অবুঝ প্রৌঢ় পুরুষ, সম বা অসম প্রেম সবখানেই আছেন তিনি। খাতার ভাঁজে পুরনো হলুদ গোলাপের মতো। বাঙালি পাঠকের ভারী আদরের ‘জয় গোঁসাই’।
তিনি পদ্যে আছেন। গদ্যেও আছেন। তাঁর উপন্যাস পড়তে গিয়ে মনে হয় এই তো জীবন, ছেঁড়া-ছেঁড়া ব্যথার স্পর্শে নতুন আলোর সন্ধান। আজীবনের মুগ্ধতায় জ্যোৎস্না জলে মন ডুবিয়ে বেঁচে থাকা।
কবিতায় সাঁতার দেওয়া যায়। পার খুঁজতে গিয়ে ফিরে আসতে হয়। কখন যে মন নদী হয়ে গেছে অলীক হৃদয়ের খোঁজ করতে গিয়ে সে নিজেও জানে না। হয়ত জানেন কবি। মুগ্ধ পাঠক শুধু মনে মনে বলে "এ কবির আঙুল ছুঁয়ে দেখি, কীভাবে জন্ম হয় অক্ষরমালার"।
এক সময় কলকাতা থেকে হয়েছিলেন নদীয়াবাসী। নদের দেশের রসের ধারা আজও তাঁর কলমেও। বৈষ্ণব পদাবলি নাগরিক রূপ পেয়েছে লিখনে। মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যাথায় কবি সাজিয়েছেন তাঁর কাব্যমালা।
তাঁর জন্ম কলকাতায়। পঞ্চাশের দশকে। সন তারিখের হিসেবে ১৯৫৪-র ১০ নভেম্বর। কলকাতা জুড়ে তখন হেমন্ত। জীবনের প্রথম পাঁচ বসন্ত কেটেছিল এই মহানগরীতেই। যখন পাঁচ বছর বয়স তখন সপরিবারে চলে আসতে হয় নদীয়ার রানাঘাটে। বাবা রাজনীতি করতেন। তাঁর কাছেই কবিতায় হাতেখড়ি। আট বছর বয়সে বাবাকে হারান। মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা।
তেরো’তে পা দিয়ে প্রথম কবিতা লেখেন। প্রথম ছাপার অক্ষরে কবিতা প্রকাশিত হয় তারও ছ’বছর পর। উনিশ বছর বয়সে। পরবর্তী ১৫-১৬ বছর যেন কবির সলতে পাকাবার দিন। লিখতে লিখতে আরও বড় পৃথিবীর পথে যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে তাঁর।
জয় আর কবিতা বাঙালির কাছে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়। কৈশোরে লেখা প্রেমের চিঠি থেকে বয়স বাড়লে ভাঙন দিনের উদযাপনে জয় গোঁসাইইয়ের কাছেই নাড়া বাঁধা পাঠক। আর কবি কীভাবে দেখেন কবিতা?
একথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন,
“সেই ষোল সতেরো বছর বয়সে যখন প্রথম কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছি, কিছুতেই একটা জিনিস বুঝতাম না তখন, কী করে একটা কবিতা ভালো লাগে। কী কারণে? তার ঠিক পাশের কবিতাটাই তত ভালো লাগে না। কেন এটা হয়?...সত্যি বলতে, এখনও বুঝিনা। আগের মতোই কেবল অভিভূত হই।”
জয় চুপিসাড়ে ভালোবাসা শেখান। সেই ভালোবাসা কখনও প্রেমের প্রতি। কখনও জীবনের প্রতি। কখনও বাবা, মা, বন্ধু পরিজন হয়ে ছড়িয়ে যায় আরও দূরে দেশ আর মাতৃভাষায়। হেসে ওঠে পাঠক-কবির দুঃখিনী বর্ণমালা। কবির কাছে এখানেই পাঠকের ঋণ…
তথ্য সূত্রঃ গোঁসাইবাগান- জয় গোস্বামী (প্রথম খন্ড)