নিজের জীবন দিয়ে বুঝি, স্বপ্ন দেখার সাহস করা উচিত... সবার। আরও বেশি করে। মাত্রাছাড়া স্বপ্ন। আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে ডানা মেলার স্বপ্ন। তার সঙ্গে যদি অধ্যবসায় থাকে, সেই স্বপ্ন সফল হবেই।
কথাগুলো গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের।
না, আপনি যাকে ভাবছেন ইনি সেই গৌতম চট্টোপাধ্যায় নন। যিনি ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’র ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন। এই গৌতম চট্টোপাধ্যায় অন্য মানুষ। তবে তিনিও ঘোড়া ছুটিয়েছেন। সে ঘোড়া স্বপ্নের। তাঁর ঘোড়া পাড়ি দিয়েছে অনেক দূর। কোন্নগরের গলি থেকে নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি। রাস্তাটা সহজ ছিল না।
উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসেছিল গৌতমের পরিবার। তাঁর জন্ম এদেশে। কোন্নগরের নবগ্রামে বাড়ি। মেঝে ছিল মাটির। ঘেঁষ আর চুনের ঘর। অ্যাসবেস্টসের চাল। অভাব আর দারিদ্রের থাবাটা কিন্তু কোনওদিন মনে আঁচড় কাটতে পারেনি। তাই স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্নে একটা নাম ঘোরাফেরা করত। ‘নাসা’। মহাকাশ।
বাবা সুনীলরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ছাপোষা চাকুরে। স্থানীয় শিশুভারতী স্কুলে। এরপর নবগ্রাম বিদ্যাপীঠ স্কুল থেকে মাধ্যমিক। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা মৌলানা আজাদ কলেজে।
বাবা আট টাকা মাসমাইনে দিতে না -পারায় ক্লাস থ্রি -র পরীক্ষার হল থেকে যাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল৷ যদিও মায়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ পরের দিন পরীক্ষায় বসতে দিয়েছিলেন তাঁকে৷ একটা পরীক্ষা কম দিয়েও সেবার দ্বিতীয় হয়েছিলেন গৌতম৷
স্কুলের শিক্ষকদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শিক্ষকদের জন্য শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে তাঁর গলায়। অনেক সময় প্রাইভেট টিউশনের খরচ বহন করতে পারত না পরিবার। শিক্ষকরা বিনা পারিশ্রমিকে দুই ভাইকে পড়িয়েছেন। গৌতমের ‘বিজ্ঞানী’ হবার স্বপ্নের বীজ এই শিক্ষকদের হাতেই ভ্রূণে প্রস্ফুটিত হয়।
স্কুল -কলেজের পরের রাস্তাটা শুধু আলোর গতিতে এগোনোর৷ প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সুযোগ পেয়েও টাকার অভাব আর চাকরির সুবিধার কথা মাথায় রেখে বাবার কথায় ভর্তি হন শিবপুরে বিই কলেজে৷ ১৯৮৭ সালে ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হয়ে পাড়ি দেন বম্বে টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে৷
গৌতম যুক্ত হন ‘জায়ান্ট মেট্রোওয়েভ রেডিও টেলিস্কোপ’ (জিএমআরটি) তৈরিতে। উচ্চশিক্ষার জন্য ফেলোশিপ পান আমেরিকার ‘ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া’ থেকে। আমেরিকায় পিএইচডি করেন ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ (ক্যালটেক) থেকে।
১৯৯৯ সালে নাসার সঙ্গে যুক্ত হন। নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরির সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট। গবেষণা ‘টেরাহার্তজ টেকনোলজি’র ওপর। ৫জি বা ৬জি–র যে টেকনোলজি আসছে, তার থেকেও বেশি গতি এই টেরাহার্তজের। নিরাপত্তার প্রয়োজনে তিনি বানাচ্ছেন টেরাহার্তজ রাডার। নাসা মঙ্গলে যে হেলিকপ্টার পাঠাচ্ছে, সেটি তৈরি করা ছাড়াও বানাচ্ছেন সেখানকার হাওয়ার গতিবেগ মাপার যন্ত্র। বৃহস্পতির উপগ্রহ ‘ইউরোপা’তে প্রাণের সন্ধানে বানাচ্ছেন যন্ত্র। দূষণ কীভাবে ‘ট্রপোস্ফিয়ার’–এর ওপরের অংশ দিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায় এবং তারা আর নক্ষত্রপুঞ্জের জন্ম কীভাবে হয়, তা জানতে বানাচ্ছেন যন্ত্র।
তাঁর নামে ১৮টা পেটেন্ট। তিনশোরও বেশি রিসার্চ পেপার। পুরস্কৃত হয়েছেন নাসার ৩৫টি নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আবিষ্কারের জন্য।
‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’, ‘আইআইটি খড়্গপুর’ এবং ‘কোচিন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’–তে প্রফেসর হিসেবে যুক্ত আছেন।
সাফল্যের সিঁড়ি হেঁটে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও এই বাঙালি বিজ্ঞানী ভুলতে পারেননি তাঁর অতীত। অনটন আর দারিদ্র্যের জীবন। আর উড়ান দেবার স্বপ্নটা। অন্ধকারের মধ্যে একা চলতে গেলে সেটাই যে একমাত্র প্রদীপ। শুধু হাজার হাওয়ার দমকেও সেই প্রদীপকে জ্বালিয়ে রাখার সাহসটা বুকের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা চাই। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মতে সেটাই দিশা।