"প্রথমে খড়ের কাঠামো, তার উপর মাটি, খড়ির প্রলাপ, তার উপর রং, ক্রমে চিত্র-বিচিত্র খুঁটিনাটি আর সমস্ত কার্য, সবশেষে অর্ধচন্দ্রাকৃতি চালের পরে দেবদেবীর মূর্তি আঁকা, তাতে আমাদের চোখের সামনে বৈদিক, পৌরাণিক দেবসভা উদঘাটিত হয়"। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের বাড়ির দুর্গা পুজোর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো আরম্ভ হয়েছিল ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে, নীলমণি ঠাকুরের হাত ধরে।
যশোহর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী। ব্রাহ্মণ পঞ্চানন কুশারী তৎকালীন সুতানুটি অঞ্চলে গঙ্গার ঘাটে ব্যবসায়ীদের পূজা-অর্চনা শুরু করেন। সেই সুবাদে তিনি অচিরেই কুশারী থেকে পঞ্চানন ঠাকুর হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পঞ্চানন ঠাকুরের দুই নাতি নীলমণি ঠাকুর এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুর। বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিবাদ লেগেই থাকত। বিবাদের ফলে একদিন নীলমণি ঠাকুর বংশের গৃহদেবতা লক্ষ্মী এবং শালগ্রাম শিলা নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। কলকাতার মেছুয়াবাজার অর্থাৎ আজকের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এক সুবিশাল বাড়ি নির্মাণ করেন।
নীলমণি ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পত্তন যেমন করেছিলেন সেইসঙ্গে তিনি ঠাকুর পরিবারে দুর্গাপুজোরও সূচনা করেছিলেন। নীলমণি ঠাকুরের একমাত্র কন্যা কমলমণি বলেছিলেন "এ বাড়ির প্রথম দুর্গাপুজো খোলা ঘরে হয়"। তবে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো রাজকীয় আকার ধারণ করেছিল নীলমণি ঠাকুরের নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়।
পুজোর তিনমাস আগে থেকেই ঠাকুর বাড়িতে পুজোর ধুম পড়ে যেত। জুতোর মাপ নিয়ে যেত চিনাম্যান। কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে হাজির হতো দর্জি। ছেলে-মেয়েদের জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ ছিল চাপকান, জরি দেওয়া টুপি আর রেশমি পোশাক। দ্বারকানাথের কাছ থেকে প্রত্যেক পুজোতেই বাড়ির মেয়ে-বউ উপহার পেতেন এক শিশি দামি সুগন্ধি, খোঁপায় দেওয়ার জন্য সোনা বা রুপোর দুল, কাঁচের চুড়ি আর নতুন বই। প্রিন্স দ্বারকানাথ পার্বণী দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই হাত খোলা ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, ভৃত্য, কর্মচারীরাও দ্বারকানাথের কাছ থেকে পেতেন নতুন জামা-কাপড় আর উপহার।
বৈষ্ণব পরিবার হওয়ায় ঠাকুরবাড়িতে ছাগের পরিবর্তে কুমড়ো বলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। দ্বারকানাথের সময় পরিবারের সকল পুরুষদের ঠাকুর দালানে আসা বাধ্যতামূলক ছিল এবং ঠাকুর দালানে এসে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করতে হতো।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তখন বারো বছর বয়স। দুর্গাপুজোর নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে উপস্থিত হলেন রাজা রামমোহনের বাড়িতে। এই আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে রামমোহন রায় বিস্মিত হয়েছিলেন। যা তাঁর চোখে মুখে প্রকাশ পায়। রাজা রামমোহনের এই বিস্ময় বালক দেবেন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যায়নি। পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন সে কথা আমাদের সকলেরই জানা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে গেলেও পিতা দ্বারকানাথের বিরুদ্ধাচরণ কিন্তু করতে পারেন নি।
দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাইদের একটি দল ছিল। তাঁরা দল বেঁধে আরতি করার সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দেবেন্দ্রনাথের কথায়-"আমরা প্রণাম করিলাম কিনা কেহই দেখিত পাইত না"। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন - "পুজোর সময় আমার পিতৃদেব কখনও বাড়িতে থাকিতেন না...পূজার ভার আমার দুই কাকা স্বর্গীয় গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের ওপর ন্যস্ত থাকিত"। গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৫৪ সালে ও নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৫৮ সালে মারা যান। নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আর দুর্গোৎসব হয়নি।
প্রতিমা নির্মাণ বাড়িতেই হতো। গরুর গাড়ি করে প্রতিমার কাঠামো আসত। পুজো উপলক্ষে রামায়ণ পালার সং, শুম্ভ-নিশুম্ভ পালার সং প্রভৃতি নানা ধরণের অনুষ্ঠান হতো। এছাড়া যাত্রাগান, নৃত্যগীতও বাড়ির উঠোনে হতো বলে জানা যায়।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ কন্যা সৌদামিনী দেবী লিখেছেন- "আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নূতন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে চলিত - আমরা মেয়েরা সেইদিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম। তখন বৎসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম"। তাঁর কথায় - "দুর্গোৎসবের সময় প্রতিমার নিকট অঞ্জলি দিয়া তবে জল গ্রহণ করিতে পাইতাম"।
বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন - "এই প্রসঙ্গে জ্যোতিবাবু বলিলেন 'বিজয়ার দিন প্রাতে আমাদের বাড়িতে বিষ্ণু গায়কের গান হইত। আমরা সকলে বসিয়া একত্রে শান্তির জল লইতাম, তারপর প্রতিমা বাহির হইত। অপরাহ্ণে আমরা অভিভাবকগণের সহিত প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের ঘাটে বসিয়া ভাসান দেখিতাম। প্রতিমা বিসর্জনের পর বাড়ি আসিয়া বুকটা বড়ই ফাঁক ফাঁক ঠেকিত - মনটাও কেমন একটু খারাপ হইয়া যাইত'।"
পরবর্তীকালে দুর্গাপুজো না হলেও জোড়াসাঁকোর বকুলতলার বাড়ি অর্থাৎ গুণেন্দ্র নাথ ঠাকুরের বাড়িতে হতো বিজয়া সম্মিলনী। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "আমাদের বাড়িতেই বসত মস্ত জলসা। খাওয়া-দাওয়া, মিষ্টি মুখ, আতর, পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ি"। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কবিগুরু মনে করতেন উৎসবের দিন একলা ঘর হয়ে ওঠে সবার ঘর।
ছবিঃ প্রতীকী