‘জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির যৌথ পরিবারে আমার ছেলেবেলা কেটেছে। বিশাল সেই একান্নবর্তী পরিবারে তখন প্রতিদিন একসঙ্গে প্রায় পঞ্চাশজন লোকের রান্না হত'। – এই স্মৃতিকথা যাঁর তিনি অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পৌত্র অমিতেন্দ্রনাথের জন্ম ৯ অক্টোবর ১৯২২। পিতা অলকেন্দ্রনাথ ও মাতা পারুল দেবী।
হেয়ার স্কুল ও স্কটিশ চার্চ কলেজের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি কম পাশ। তারপর বিশ্বভারতীর চিনা ভবনে ও পরে পিকিং -এ চিনা ভাষা ও সাহিত্যে পাঠ গ্রহণ। এ হেন অমিতেন্দ্রনাথের শৈশব ও কৈশোর স্মৃতি জুড়ে ছিল জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়ি ও বেলঘরিয়ার গুপ্তনিবাস। দাদামশায় অবনীন্দ্রনাথ, বড়দাদামশায় গগনেন্দ্রনাথ, দিনু জ্যাঠামশায় থেকে কত্তাবাবা
রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে সমৃদ্ধ শৈশব-কৈশোরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত। কখনও বিকেলবেলা পাঁচ নম্বর বাড়ির ছেলেমেয়েরা গোল বাগানে পাথর বাঁধানো গোল রাস্তার ওপর দিয়ে রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলতে খেলতে তারস্বরে গাইত ‘এনেছি মোরা এনেছি মোরা রাশি রাশি লুটের ভার '। এমন সময় ৬ নম্বর বাড়ির ওপরের ঘর থেকে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমিতেন্দ্রনাথের দিনু
জ্যাঠামশাই তাদের ডেকে বিচিত্রা ভবনে বসে শেখালেন রবীন্দ্রনাথের নতুন লেখা গান 'এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে’। তারপর ছোটরা সকলে মিলে আবার রেলগাড়ির খেলা শুরু করল, এবার, ’এসো নীপবনে' গানের সঙ্গে। গান শুনে অরুনেন্দ্রনাথ ঠাকুর - দিনেন্দ্রনাথের কাকা - তাদের থামিয়ে বলছেন 'ধ্যাৎ! এ আবার একটা গান হল! দাঁড়া এবার আমি তোদের একটা গান শেখাব’।
এরপর গোল বাগানের বেঞ্চিতে বসে গান শেখানো হল - ‘মাকড়টা ফুলবনে খাসা বোনে জাল/ পোকামাকড় লটকে পড়ে/ মাছি পালে পাল'। গান শুনে অবনীন্দ্রনাথ পাঁচ নম্বর বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে হাঁক পেড়ে জানতে চাইলেন "এ গান তোমাদের কে শিখিয়েছেন?" উত্তর শুনে তিনি আর কিছু বললেন না। অনেক কাল পরে,’আট বছরে শেখা গান চুরাশি বছরে’
শান্তিনিকেতনে বাড়ির বারান্দায় বসে গাইছিলেন অমিতেন্দ্রনাথ-সামনের পথ দিয়ে যেতে যেতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী মোহন সিং বাড়িতে ঢুকে তাঁকে গানটি আবার গাইতে বললেন। শুনে বললেন "এ তো মারু বেহাগ"। কোন শৈশবেই শেখা হয়ে গিয়েছিল মারু বেহাগ। এমনই আলোকময় ছিল তাঁর শিশু কাল।
অবশ্য আনন্দই নয় শুধু, অবনীন্দ্রনাথের কাছে জুতো পেটাও খেয়েছেন তিনি। ঘটনাটা ছিল এইরকম - পাঁচ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়ির একতলায় অবনীন্দ্রনাথের স্নানঘরের লাগোয়া ছিল এক পরিষ্কার জলে ভরা বিশাল চৌবাচ্চা। সেখানে অবনীন্দ্রনাথের স্নান করার আওয়াজ শুনে বালক অমিতেন্দ্রনাথের খুব ইচ্ছে হত ওখানে স্নান করার।
কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের কড়া নিষেধ ছিল, কোনো বাচ্চা যেন ওই চৌবাচ্চায় না নামে। কৌতুহল তো নিষেধ মানে না। তাই একদিন সকালে পা টিপে টিপে সেই চৌবাচ্চার পাড়ে উঠে চৌবাচ্চার চওড়া সিমেন্টের পাড়ের ওপর পেট রেখে 'মনের আনন্দে শুধু দুটো হাত দিয়ে জলের ওপর চাপড়াচ্ছি' পা দুটো শূন্যে, এমন সময় কোনো কারণে অবনীন্দ্রনাথ এসেছিলেন নীচে। তাঁর চোখে পড়ল এই দৃশ্য। ধরে নিয়ে গেলেন অন্দরমহলের ভিতরের বারান্দায়, যেখানে 'ভালু’ কুকুরের চেন ঝুলছিল সেটা এনে বালক
অমিতেন্দ্রনাথের গলায় বেঁধে ডাকলেন তার মা, অবনীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ পারুল দেবীকে। ছেলের কীর্তির কথা জানিয়ে বললেন, 'একে তো একটা শাস্তি দিতে হবে’। বলে ‘পায়ের তুলতুলে লপেটা জুতো দিয়ে আমার পিঠে দুবার সজোরে আঘাত করলেন’। এ আঘাত তেমন লাগেনি অমিতেন্দ্রনাথের কিন্তু কুকুরের চেন দিয়ে বাঁধা অবস্থায় সবার সামনে মার খাওয়ার লজ্জা তিনি চুরানব্বই বছরেও ভুলতে পারেননি।
খেলাধূলার প্রতি খুব আকর্ষণ ছিল অমিতেন্দ্রনাথের। হেয়ার স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিয়মিত খেলতেন। শান্তিনিকেতনে ক্রিকেট খেলার আগ্রহেই যোগ দেন চিনা ভবনে। আর তারপর বদলে যায় অমিতেন্দ্রনাথের জীবনের গতিপথ। বিশ্বভারতীতে তখন পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় ডিগ্রি নেওয়া হয়নি।
১৯৪৬ সালে ভারত সরকারের সহায়তায় পিকিং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চিনা ভাষা শিখতে গেলেন। ১৯৪৮ সালে চিনে মাও সে তুং ক্ষমতায় এলে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে অনেকে ভয় পেয়ে দেশে ফিরে এলেও অমিতেন্দ্রনাথ থেকে গেলেন। এমএ পাশ করে ফিরলেন দেশে। ফিরে বিশ্বভারতীতে শুরু করলেন শিক্ষকতা। অধ্যাপনা করেছেন ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি ও ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও। তিনি বিশ্বভারতীর চিনা ভবনের প্রথম পিএইচডি।
১৯৬৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ তেইশ বছর। তবে দেশে আসতেন নিয়মিত। কেননা, ‘শান্তিনিকেতনের মতো ভালো আর কোথাও লাগেনি’। দীর্ঘ কর্মময় জীবনের পর ১৯৮৭ সালে অমিতেন্দ্রনাথ কলকাতার সল্টলেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে ব্যাপৃত ছিলেন চিনা সাহিত্য অনুবাদে।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর চিনা সাহিত্যিক লাওৎসের লেখা 'তাও তে চিং' নিয়ে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। এছাড়া চিনাংশুক, মোমেন্টস্ অফ রাইজিং মিস্ট, চিনা ছোট গল্পের সংকলন চিনামাটি (মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্মভাবে), তাঁর আত্মকথা ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য বই।২০২১এর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে শান্তিনিকেতনের সবার প্রিয় বীরুদা, অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মৃত্যু এসে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল হয়ত সেই পাঁচ নম্বর বাড়িতে, যেখানে চিরকাল তাঁর দাদামশায়রা ছবি আঁকেন আর বাগানে খেলে ছোট্ট বীরু আর তার ভাইবোনেরা।।