বাংলায় ব্লাড ব্যাঙ্ক আন্দোলনের বিদেশি কান্ডারি - জন গ্র্যান্ট

'যুদ্ধ লেগেছে, যুদ্ধ লেগেছে!!' পয়লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ সালের সকাল। খবরের কাগজের হকারদের তুমুল চিৎকারে জেগে উঠল পাড়া। নড়েচড়ে বসল শহর কলিকাতা, টনক নড়ল ইংরেজ সরকারের। ততক্ষণে সাধারণের হাতে এসে গিয়েছে সেদিনের 'অমৃতবাজার পত্রিকা'-র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বার্তাবাহী বিশেষ সংখ্যাটি। তাতে জ্বল জ্বল করছে যুদ্ধের খবর--জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করেছে! এদিকে দিন গড়াতে গড়াতে যুদ্ধে নামার জন্য জাপানও তাল ঠুকে পা ঘষতে শুরু করে দিল। ফলে,  কলিকাতায় একেবারে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। সরকারের আশঙ্কা, বিমান বাগিয়ে মালকোঁচা মেরে 'আও শালে' বলে জাপান মাঠে নেমে পড়লে সবার আগে বোমা ফেলবে এসে আমাদের কলিকাতায়। সুতরাং, তক্ষুনি লাল সতর্কতা জারি হল! এ আর পি অর্থাৎ এয়ার রেইড প্রিকোশন স্কোয়াডও তৈরি হয়ে গেল। রাস্তার আলো, গাড়ির হেডলাইট-এ ঠুলি পরানো হল, জানলার শার্সিতে কাগজ সাঁটা হতে লাগল। আর সেটা দেখভালের জন্য পাড়ায় পাড়ায় 'লাইট রেস্ট্রিক্টার'ও জুটে গেল। জীবন হয়ে উঠল সাইরেন আর শেল্টারময় আতঙ্কের আর এক নাম। 

শেষমেশ ১৯৪১-এর শেষ দিকটায় জাপান আর থাকতে পারল না, অক্ষশক্তির হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অমনি দিল্লি থেকে গভর্ণরের গাদাগুচ্ছের নিরাপত্তামূলক নির্দেশ ছুটতে ছুটতে হাজির হলো।  তার দরুণ, প্রথমেই কলিকাতার 'রুলিং প্রিন্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া'-র রেসিডেন্সটিকে বেমক্কা হাসপাতাল করে দেওয়া হল, যাতে যুদ্ধে আহত সৈন্যদের নির্বিঘ্নে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া যায়। আর একটি ঘোষণায় বলা হল,  দেশের প্রতিটি প্রদেশে অন্তত একটি করে 'ব্ল্যাড ব্যাঙ্ক' গড়ে তুলতেই হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!

দেশে তখন একটাও ব্ল্যাড ব্যাঙ্ক ছিল না। অথচ চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগেই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা গেছে যুদ্ধ এবং বিমানহানায় আহত মানুষের জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে জরুরি জিনিস ছিল, রক্ত।  সরাসরি মানুষ থেকে মানুষে রক্ত সঞ্চার করেই তখন অনেকের প্রাণ বাঁচানো গেছে। তারপর মধ্যিখানের এই বছরগুলোতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে রক্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণ করে মানুষের জীবন বাঁচানো সহজ হয়েছে। এই সংরক্ষণের সূত্রেই ১৯৩৭ সাল থেকে 'ব্লাড ব্যাঙ্ক' শব্দ-বন্ধের জন্ম হল। 

এদেশে সরকারী নির্দেশ পেয়ে দেশের মধ্যে যে মানুষটি প্রথম এগিয়ে এলেন, তিনি বিদেশি। তাঁর নাম, জন ব্ল্যাক গ্র্যান্ট। কলিকাতার চিত্তরঞ্জন এভিনিউ-তে যে  'অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন এন্ড পাবলিক হেলথ' প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, উনি তার ডিরেক্টার। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়।  এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পেছনে গ্র্যান্টের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, আর ছিল টুকরো টুকরো ত্যাগ। সেই স্বপ্নের টানেই পিকিংয়ের ইউনিয়ন মেডিকেল কলেজের পাবলিক হেলথ প্রফেসরের চাকরিটি অনায়াসে ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলেন। আসলে, এ-দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নতুনভাবে বিন্যাস করে, জনমুখী করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই ছিল তাঁর বহুলালিত স্বপ্ন। তাই ব্লাড ব্যাঙ্ক গড়ার নির্দেশিকাটি পেয়ে সবার আগে তিনিই সেই আনন্দযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ঝাঁপিয়ে পড়েই বুঝলেন এ-কাজে গতি আনতে চাই দীর্ঘদিন ধরে এদেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত আছে এমন একটি সংস্থার সাহায্য। ১৯২০ সাল থেকেই 'ইন্ডিয়ান রেডক্রস সোসাইটি' (বাংলা শাখা)-জনস্বাস্থ্যর কাজে সুনামের সঙ্গে যুক্ত।  এরকম সংস্থাকেই তো আজ পাশে চাই। তিনি সাহায্য চাইলেন নির্দ্বিধায়। উল্টোদিক থেকেও এগিয়ে এলো উষ্ণ বন্ধুত্বের হাত। আর এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে এগিয়ে এলেন বাংলার গভর্ণরও। দান করলেন আধুনিক এয়ার কন্ডিশন মেশিন, ল্যাবের জন্য ব্ল্যাড ফিল্টারেশনের প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র। ফলে অবিলম্বেই, 'অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন এন্ড পাবলিক হেল্থ'-এর ক্যাম্পাসেই প্রতিষ্ঠিত হল আধুনিক বৈজ্ঞানিক সুবিধেযুক্ত দেশের প্রথম ব্ল্যাড ব্যাঙ্ক, 'ক্যালকাটা ব্লাড ব্যাঙ্ক'।

পাকদন্ডী এবার চড়াই হল। লড়াই শুরু হল গ্র্যান্টের। তিনি ব্ল্যাড ব্যাঙ্ক তো গড়ে তুললেন, কিন্তু তাতে ভয়ে নিজের রক্ত কিছুতেই কেউ দান করতে চায় না! হাজার রকমের ভ্রান্ত ধারণা। গ্র্যান্ট বুঝলেন ধীরে এগোলে অনেক সময় লাগবে। অত সময় নেই হাতে। অবিলম্বে গড়ে তুলতে হবে 'ব্লাড ডোনেশন মুভমেন্ট'। ব্যাপক প্রচার করতে হবে, সচেতনতা শিবির করতে হবে আর সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের রক্তদানের ব্যাপারে এগিয়ে আনতে হবে। তাদের দেখেই এগিয়ে আসবে সাধারণ মানুষ। কারণ, সওদাগর চাঁদের হাত দিয়ে পুজো না-হলে এদেশের মানুষ দেবী মনসারও পুজো করে না।

১৪ মে ১৯৪২ তিনি একটা দারুণ ব্যাপার ঘটিয়ে ফেললেন। প্রচারে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের মেম্বার মিঃ এন বি সরকার এবং ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের ডিরেক্টার জেনারেল স্যার গর্ডন জোলিকে সামনে রেখে এক বিরাট সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করলেন প্রতিষ্ঠানের সভাঘরে। বিখ্যাত কাগজের সাংবাদিকেরা সবাই সেখানে উপস্থিত। তাঁদের কাছে গ্র্যান্ট স্পষ্টই বললেন যে, দেশের জরুরি অবস্থায় ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোতে পাঁচ হাজার লিটার ব্লাড সংরক্ষণের প্রয়োজন। যুদ্ধে কেউ আহত হলে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ছাড়া বাঁচানো সম্ভব নয়। এতটা রক্ত সংগ্রহের জন্য সাধারণ মানুষকে দাতা হয়ে এগিয়ে আসতেই হবে। রক্তদানে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না, নিত্যদিনের কাজের কোন ব্যাঘাত হয় না। দানের কাজটি মাত্র পনেরো মিনিটেই সম্পন্ন হয়ে যায়। সেদিন এভাবেই মিডিয়ার সাহায্যে শিক্ষিত সাধারণ মানুষের কাছে সত্য এবং সদর্থক দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করলেন গ্র্যান্ট। 

গ্র্যান্টের উদ্দেশ্য ও চেষ্টা বুঝতে পেরে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলার গভর্ণরের স্ত্রী মেরি হারবার্ট ক্যালকাটা ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে রক্তদান করলেন। আর গভর্ণর সাহেব করলেন পরের সপ্তাহে। দুটোই খবর হল। তাঁদের দেখাদেখি মোসাহেব আর পার্ষদেরাও রক্তদান করল। গ্র্যান্ট দেখলেন, ব্যাপারটা এবার আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে। 

মে মাসে গ্র্যান্ট ব্ল্যাড ডোনেশন ক্যাম্প করলেন মারওয়ারি সোসাইটিতে। সোসাইটির সেক্রেটারি তুলসীরাম সারোগী বিপুল জনতার সামনে রক্ত দিলেন। সেইসঙ্গে দারুণ বাগ্মীতার সঙ্গে রক্তদানের সপক্ষে সুন্দর বক্তৃতা করলেন। কথায় ও কাজে ঐক্য দেখে প্রভাবিত হয়ে  অসংখ্য মানুষ সেদিন স্বেচ্ছায় রক্ত দান করলো। 

বড়বাজারে ব্যবসার কাজে শহর এবং শহরের বাইরের অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন আসেন।  উৎসাহী গ্র্যান্ট  তাদের কাছে রক্তদানের ভালো দিকগুলো তুলে ধরতে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি শুরু করলেন। এসব করে যে কাজ হচ্ছে, তার প্রমাণ পেলেন গ্র্যান্ট ২১ মে। এদিন তাঁরই আদর্শে প্রাণিত হয়ে চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে একটি ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠা করলেন পনেরো জন ডাক্তার। আমন্ত্রিত অনেক গণ্যমান্য মানুষের সঙ্গে সেদিন এখানে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ও রক্তদান করেছিলেন। 

একটা বৈপ্লবিক কাণ্ড করে বসলেন গ্র্যান্ট। সেটা জুন মাসের আট তারিখ। এদিন কয়েকজন চিকিৎসক নিয়ে রক্তদানের ডেমো দিতে সটান হাজির হলেন একেবারে বিড়লা ব্রাদার্স লিমিটেডের অফিসে। তাঁর সহজ ও সুন্দর বক্তব্যে খুশি হলেন বি কে বিড়লা।  কাজেই তিনি  তো ব্লাড দিলেনই, তাঁর দেখাদেখি প্রথমে ছ'জন, তারপর সমস্ত এমপ্লয়ী ব্ল্যাড দিতে চাইলেন। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। কে আগে প্রাণ, করিবেক দান--গোছের ব্যাপার হয়ে উঠল।  সেদিন অবশ্য এত মানুষের রক্ত নেবার কিট সঙ্গে ছিল না, তাই যাঁরা বাকি রইলেন, পরে একদিন তাঁদের রক্ত নেওয়া হল।

paper (1)

শিক্ষিত সমাজ, শিল্পপতি সমাজ হল। গ্র্যান্ট ভাবলেন, এবার কোন তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে যদি রক্তদানের ব্যাপারে রাজি করানো যায়, তাহলে আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করা যাবে, আন্দোলনকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। তিনি তাই সটান রক্তদানের অনুরোধ জানিয়ে, এর বৈজ্ঞানিক দিকটি ব্যাখ্যা করে তরুণ নেতা জওহরলাল নেহেরুকে চিঠি দিলেন। গুরুত্ব বুঝে জহরলালও উত্তর দিলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে--

"I should like indians to contribute their quota to these banks wherever it is possible to do so...I understand from your letter that you have already received the  co-operation of many more will donate their blood for this humanitarian object. It would be a pity if political or other consideration came in the way of this kind of work...For my part I would be glad to give my own blood for this purpose..."

এভাবেই যুদ্ধ শঙ্কিত বাংলায় বুদ্ধি দিয়ে, অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে রক্তদান আন্দোলনের তরঙ্গ গ্র্যান্ট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলার নগর থেকে গ্রামে।  শুধু প্রচার ও প্রসারেই থেমে থাকেননি  সাধের ব্ল্যাড ব্যাঙ্কটিতে ফিল্টারেশনের জন্য বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্র, কোল্ড স্টোরেজ, প্লাজমা সংরক্ষণের ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটিয়েছিলেন। যুদ্ধ-পরিস্থিতি শেষ হলে তাঁর সাধের এই ব্ল্যাড ব্যাঙ্কটি আর তাঁর হাতে রইলো না, ১৯৪৫-এ সেটি স্থানান্তরিত করে দেওয়া হল কলিকাতা মেডিকেল কলেজে। আর আমরাও ভুলতে শুরু করলাম এই মানুষটির অবদান। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...