মানুষটি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘বাকি কটা লাইন গভীর অন্ধকারে শেষ করলাম, গভীর অন্ধকার। পরদিনের আলোর জন্য রাখা নয়।’
অন্ধকারের মধ্যে যেন এক তীব্র বিপন্নতার বাস। আলোতে ফেরার ইচ্ছেগুলো ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। আঁচড় কাটছে বিষাদ। আর মানুষটি পাক খাচ্ছেন তার মধ্যে। নিঃসঙ্গ। একাকী।
নিবিড় বিমূর্তায় ডুবে যাওয়া একজন মানুষ। আঁকড়ে ধরছেন লেখনীকে। আশ্রয় খুঁজছেন নিজস্ব শব্দের পৃথিবীতে। নীল ঘাস আর হিজল অশথের কাছে।
তিনি জীবনানন্দ দাশ। যাঁর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে এক বিষাদ রঙের মুখ। শ্রান্ত। কিছুটা যেন ক্লান্ত। এই পৃথিবী একবারই পেয়েছিল সেই কবিকে। তার পর হিম রাতে নক্ষত্রের মত হারিয়ে গিয়েছেন চিরতরে। এমনই অক্টোবরের কুয়াশায়।
সালটা ১৯৫৪। ১৪ অক্টোবর। বিকেল বেলা ল্যান্সডাউনের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। বালিগঞ্জের ‘জল খাবার’ এর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হাতে ডাব। বাড়ি ফিরছেন কবি।
কানের কাছে ট্রাম চালকের চিৎকার, ট্রামের ঘন্টার আওয়াজ কিছুই তিনি শুনতে পেলেন না।
ট্রামে ধাক্কায় সঙ্গে সঙ্গে শরীর ক্যাচারের মধ্যে । চুরমার হয়ে গিয়েছে বুকের পাঁজর, প্রায় থেঁতলে যাওয়া, গুরুতর আহত জীবনানন্দকে নিয়ে যাওয়া হল শম্ভুনাথ পন্ডিত হসপিটাল।
২২ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হল।
জীবনান্দের মৃত্যুর প্রসঙ্গে ভূমেন্দ্র গুহ বলেন, ‘কলকাতার ইতিহাসে জীবনানন্দই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।’
জীবনানন্দ দাশ। সাকিন বরিশাল। এই শহর তাঁর কাছে অনেকটা অনাত্মীয়ের স্পর্শ নিয়ে ধরা দিয়েছিল।
কন্যা এবং স্ত্রী কে রেখে এসেছিলেন বরিশালে।
কলকাতা শহরের ট্রাম লাইন আর অনেক দূরে ফেলে আসা ধানসিঁড়ি নদী। বুকের খুব গোপনে ঘাই মারতে থাকা বরিশাল। অনেকটা দূরে ছেড়ে আসা সেই ভূমি তাঁর রূপসী বাংলা। শব্দে শব্দে বারবার এঁকে চলেন তার ছবি। দৃশ্যকল্প।
হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং। সেখান থেকেই ট্রামের নেশা যেন পেয়ে বসেছিল জীবনানন্দকে। মেসের ১১ নম্বর ঘরটা বড় বেশি প্রিয় ছিল। তার জানলা থেকে ভারি স্পষ্টভাবে দেখা যেত মধ্য কলকাতার ট্রামলাইনটা। ট্রাম ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখাতেই। যেন অমোঘ নিয়তির মতো। ট্রাম তাঁর ভাষায় ‘দার্শনিক যান’। ব্যস্ত শহরের বুকের ওপর দিয়ে নির্লিপ্ত বয়ে যাওয়া। দ্রুততার বিপরীতে আপাত মন্থর।
গদ্যের ভাষা দিয়ে ধরা যায় না তাঁকে। কারুর কারুর মতে, তাঁকে অনেক বেশি স্পষ্ট ভাবে চেনা যায় তাঁর গদ্য দিয়ে। সেখানে যেন ধরা দিতে চান বারবার অধরা দিয়েই।
লেখনীর চিত্রময়তায় মুগ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে সার্থক কবি হিসেবে সব চেয়ে বেশি যে নামটি উঠে আসে সেটি জীবনানন্দের নাম।
অনেকের কাছেই তিনি ধাঁধাঁ। দুর্বোধ্য কবিতার মতো। যার অক্ষরগুলোকে দেখা যায়, উচ্চারণ করা যায়, কিন্তু স্পর্শ করা যায় না।
জোড়াতালি দাম্পত্য নিয়ে চাকরির খোঁজ। ব্যতিব্যস্ত নাগরিক জীবনে খুঁজে চলেন হেমন্তের আঁধার। সেখানে কিছু ধান ঝরে পড়ে শিষ থেকে। মেঠো ইঁদুর কুড়িয়ে নেয়।
ঘর ছেড়ে ছিলেন জীবনান্দ। ট্রাম লাইনেই শেষ হয় পথ। অনেকের কাছেই জীবনানন্দের মৃত্যু তাঁরই মতো রহস্যময়। আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা?
তাঁর কবিতায় ডুবে থাকা মুগ্ধ বাঙালির এ যেন এক অন্তহীন অনুসন্ধান।
আলোচক ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, “তাঁর ডায়েরির লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তিনি মৃত্যুচিন্তায় চিন্তিত ছিলেন। এক্ষেত্রে এটা আত্মহত্যা হলেও হতে পারে।"
নির্জনতম কবির বহু কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে মৃত্যু চেতনা। রূপকের মাধ্যমে। কখনও ঝরা ধান, কখনও মেঠো ইঁদুর আবার কখনও চিলের ছোঁয়ে। কিন্তু কোথাও তো জীবন ছিল। আকুতি ছিল। আকস্মিক ফুরিয়ে যাওয়ার আকুতির মাঝে জ্বলজ্বল করে, মৃত্যু বিষণ্ণতার মাঝে সূর্য ওঠে জীবনের আকাঙ্খায়। কবি লেখেন,
‘চলছে নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু রীতি, মানুষের বিষয়, হৃদয়;
জয় অস্তসূর্য, জয়, অলক অরুণোদয় জয়।’
মৃত্যু শয্যায় কবির নিকটাত্নীয় স্বনামধন্য চিকিৎসক শ্রী অমল দাশকে দেখে কবি তাই বলে ওঠেন,
‘কে বুবু ? বুবু এসেছিস ? বাঁচিয়ে দে....।
( তথ্য ঋণঃ জীবনানন্দ স্মৃতি । সুবোধ রায়, জীবনানন্দের ডায়েরি-১, গৌতম মিত্র
)