ছক ভেঙেছেন 'চাকদা এক্সপ্রেস'

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে সিএবির এক অনুষ্ঠানে  প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন ঝুলন। সেই অনুষ্ঠানে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, এক জীবনে একটা ঝুলনেরই দেখা পাওয়া যায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দীর্ঘ কুড়ি বছরের ক্রিকেটযাত্রা শেষ করেছেন ঝুলন। ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডের মহিলা ক্রিকেট দলকে ওদের দেশের মাটিতে ৩-০'য় হারানোর সঙ্গেই লর্ডসের মাটিতে অবসর নেন 'চাকদা এক্সপ্রেস'।

সৌরভ বলেন, মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি ওর অবদান ভোলার নয়। আমি খুবই খুশি ইংল্যান্ডে শেষ তিনটি ওয়ান ডে-ই ও খেলেছে। লর্ডসের মতো মাঠে শেষ করেছে ক্রিকেটজীবন। যোগ্য সম্মান পেয়েছে। আশা করব, ভারতীয় ক্রিকেটকে ও আরও কিছু দেবে।''

লর্ডসে বিদায়ী ম্যাচে ঝুলনের শেষ উইকেট প্রাপ্তির সময়ও চোখের কোণ মুছেছিলেন সতীর্থ অধিনায়ক হরমনপ্রীত। এই সূত্রে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাংলা তথা ভারতের কিংবদন্তি মহিলা ক্রিকেটার ঝুলন বলেন, "আমি কখনও আবেগ নিয়ে ক্রিকেট মাঠে নামি না, আমি নির্মম।" এক্ষেত্রে ভারতের আরেক ক্রিকেটার 'ক্যাপটেন কুল'-এর সঙ্গে ঝুলনের বেশ কিছুটা মিল আছে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির আবেগ যেমন তাঁর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন, ঝুলনের ক্ষেত্রেও বোধ হয় তেমনই। পাশাপাশি বলতেই হচ্ছে, আবেগ ছাড়া মাঠে নেমে কেউই সফল হতে পারেন না। আর তাই তো ঝুলন মহিলাদের বিশ্বক্রিকেটে নিজের জীবনসফর সম্পূর্ণ করে সর্বাধিক ৩৫৫টি উইকেট তাঁর শো-কেসে সাজাতে পেরেছেন।

 

Jhulan1

 

অভিজ্ঞতাতে ভর করে বলাযায়, এ দেশে ছেলেদের ক্রিকেট নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ও ক্রীড়াপ্রেমীদের মধ্যে আজও যা মাতামাতি হয়, তার অনেকটাই অনুপস্থিত থাকে মেয়েদের ক্রিকেটে। তবে আনন্দ এটাই, 'চাকদহ এক্সপ্রেস' ঝুলন কিন্তু এ-ধারণাটা কিছুটা মুছে দিতে পারলেন নিজের সাফল্যের জোরে।

২০০২ সালে চেন্নাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় ১৯ বছর বয়সী ঝুলনের। ঐ বছরই জানুয়ারি মাসে টেস্ট অভিষেক লখনউতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই। জীবনের আর শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচেও প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। তাদের ঘরের মাঠ লর্ডসে।

'৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিবেশীর টিভিতে দেখতে বসেই ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণ জন্মায় ঝুলনের। সেই শুরু। কিন্তু পাড়া ক্রিকেটে খুশি ছিলেন না। চাইতেন আরও বেশি ক্রিকেট খেলতে। আরও বেশি শিখতে। কিন্তু কাছেপিঠে কোচিংয়ের সুযোগ নেই যে! অগত্যা গন্তব্য কলকাতা। বিবেকানন্দ পার্কে স্বপন সাধুর কাছে প্রশিক্ষণ শুরু ঝুলনের। কিন্তু লড়াইটা অতটাও সহজ ছিল না। লোকাল ট্রেনে কয়েক ঘণ্টার যাতায়াত, জাঁকাজাঁকি ভিড়ে ক্রিকেট কিট কাঁধে থাকা ছোট্ট মেয়েটিকে দেখে কারও টিপ্পনী কিংবা শুধু খেলার জন্য বাড়ির লোকের বকুনি— 'চাকদহ এক্সপ্রেস' হতে লেগেছে বিস্তর পরিশ্রম আর অনেকখানি ত্যাগ।

 

Jhulan2

 

একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর উঠে আসা প্রসঙ্গে ঝুলন বলেছিলেন, মধ্যবিত্ত পরিবার কখনও মেয়ের কাছ থেকে অসাধারণ কিছু আশা করে না। অভিভাবকরা চান, মেয়ে পড়াশোনা করবে, গান-বাজনা-নাচ ইত্যাদি চলতে পারে। কিন্তু খেলাধুলোকে পেশা করা? নৈব নৈব চ। ঝুলন অবশ্য মনে করেন না যে তিনি এই ছক ভেঙেছেন। তিনি শুধু যা হতে চেয়েছিলেন তা মন থেকে চেয়েছিলেন। এবং হতে পেরেছেন।

বাইরের লোকের ভ্রূকুটি, পরিবারের বাধা, আর্থিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা— কোনও কিছুই রুখতে পারেনি 'চাকদহ এক্সপ্রেস'-এর গতিপথ। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির চেহারার ১২০ কিলোমিটার বেগে বলের লক্ষ্য শুধু ব্যাটারকে ধরাশায়ী করা নয়, নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে যাওয়ারও। ১৯৮২ সালের ২৫ নভেম্বর নদিয়ার চাকদহ পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড লালপুরে জন্ম ঝুলন গোস্বামীর। বাড়ির সবাই ডাকেন বাবুল নামে। বাবা নিশীথ গোস্বামী ছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার ক্যান্টিন কর্মী। থাকতেন ছোট্ট বাড়িতে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ঝুলনেরও প্রথম ভালবাসা ছিল ফুটবল।

ঝুলনের কথায়, তিনি কী পেয়েছেন বা কী পাননি তার হিসাব রাখতে ভালবাসেন না। কোনও কিছুর জন্য খেদও নেই তাঁর। নিজেকে প্রমাণ করতে করতে অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। আইসিসির বর্ষসেরা মহিলা ক্রিকেটারের সম্মান, পদ্মশ্রী, অর্জুন— সরকারি, বেসরকারি অজস্র সম্মান ও খেতাব পেয়েছেন ৩৯ বছরের পেসার। এক দিনের ক্রিকেটে ঝুলনের ঝুলিতে রয়েছে ২৫২টি উইকেট। টেস্টে রয়েছে ৪৪টি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিয়েছেন ৫৬টি উইকেট। বাংলার দলে মেন্টরের দায়িত্ব আছেন। বাংলার ক্রিকেট 'দাদা' সৌরভের পর পেয়েছে 'দিদি' ঝুলনকে। মেয়েরাও যে ১৩৫ কিলোমিটার গতিতে বল করতে পারেন, তা শিখিয়েছেন ঝুলনই। সেরা সময়ের ঝুলনের বোলিং বিপদে ফেলত পারত যে কোনও পুরুষ ব্যাটারকেও।

 

Jhulan3

 

লর্ডসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শেষ ম্যাচেও দু'টি উইকেট ছিল ঝুলনের। যা বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁর স্মৃতিতে। ঝুলন বলেছিলেন, ''ভারতীয় দলের হয়ে প্রথম উইকেটের কথা কখনও ভুলব না। সে রকমই শেষ উইকেটও ভোলা সম্ভব নয়। মাঝে অনেক সাফল্য পেয়েছি। এমন অনেক ম্যাচ খেলেছি যা সম্প্রচার হয়নি। সেগুলোর স্মৃতিও মনে গেঁথে রয়েছে। ২০১৭ বিশ্বকাপ ফাইনালের কথাও মনে থাকবে।''

অবসরের পর কলকাতা ফিরে ঝুলন জানিয়েছিলেন যা করতে পারেননি, তা এ বার একে একে পূরণ করতে চান। বলছিলেন, ''বিরিয়ানি খাওয়া হয়নি বহু দিন। এখন আর সে ধরনের খাবারে কোনও নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকাও খেতে ইচ্ছে করে। সেই স্বাদ ফিরে পেতে চাই। ভোরবেলায় উঠে ট্রেনিংয়ে আর যেতে হবে না। এটাই সব চেয়ে শান্তির। দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে পারব।''

ঝুলন গোস্বামীর অবসরে আবেগপূর্ণ বার্তা দিয়েছিলেন মিতালীরাজ। বলেছিলেন, ভারতীয় জার্সি তোমার অভাব অনুভব করবে ঝুলু। মিতালীও ঝুলন দু'জনে মিলে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটকে নিয়ে গিয়েছেন শীর্ষে। অল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন দুই বন্ধু।

মিতালীবলেছিলেন, যে ভাবে পেস বোলার হয়েও দু'দশক ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শাসন করেছেন ঝুলন, তা অবিশ্বাস্য। ঝুলনের ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধতারও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, সব সময় ইতিবাচক থাকার বিরল গুণ ছিল ভারতীয় পেসারের। অবসরের সময়েও নতুন আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে পাঁচ নম্বর বোলার ছিলেন ৩৯ বছরের বঙ্গ পেসার।

 

Jhulan4

 

মিতালির কথায়, ''মহিলা ক্রিকেটে ফাস্ট বোলার হিসেবে যে দীর্ঘ সময় ধরে শাসন করে গিয়েছে ও, তা ভাবা যায় না! অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে আমরা একসঙ্গে খেলেছি। দেখেছি ক্রিকেটের প্রতি ও কতটা দায়বদ্ধ।'' যোগ করেছেন, ''সব সময় ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখার বিরল গুণ ছিল ঝুলনের মধ্যে। যা সকলের কাছে উদাহরণ এবং শিক্ষণীয় হয়ে থাকতে পারে। ভারতীয় জার্সি তোমার অভাব অনুভব করবে, ঝুলু।'' বিদায়ী ম্যাচ খেলতে নামার আগে ঝুলনকে নিয়ে মিতালীবলেছিলেন, নেট প্র্যাক্টিসের সময়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খামতি থাকত না ভারতীয় পেসারের। ''নেটে প্রায়ই আমি ওকে জিজ্ঞেস করতাম, কেন প্র্যাক্টিসেও আগুন ঝরাচ্ছ? তুমি তো আমার নিজের দলেরই সতীর্থ। তার উত্তরে ও বলত, 'তোমাকে আউট করা কঠিন, তাই'। ঘরোয়া ক্রিকেটেও দেখতাম, ঝুলন সব সময় ওর একশো শতাংশ দিয়ে চলেছে।''

অক্টোবর মাসে ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলের দুই প্রাক্তন ক্রিকেটার ঝুলন গোস্বামী ও মিতালী রাজকে বিশেষ সম্মান দিয়েছিল ভারতীয় রেল। ট্রেনের টিকিটে জায়গা করে নিয়েছেন দুই ক্রিকেটার। টিকিটে আঁকা কার্টুনে দেখা যাচ্ছিল মাঠের মধ্যে উল্লাসে ব্যস্ত ঝুলন ও মিতালি। দুর্গাপুজোর মধ্যে ঝুলন-মিতালির এই টিকিট বিক্রি করেছে রেল। ঠাকুর দেখতে গিয়ে অনেক যাত্রীই হাওড়া-শিয়ালদহ থেকে এই টিকিট পেয়েছেন। উৎসবের পাশাপাশি ঝুলনদের টিকিট পেয়ে আপ্লুত হয়েছেন তাঁরা। যত্ন করে রেখে দিয়েছেন সেই টিকিট।

ক্রিকেট যদিও একেবারে ছেড়ে দেননি ঝুলন। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন না। এমনিতে ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলার জার্সিতে তাঁকে দেখা যেতেই পারে। কারণ, সামনে মেয়েদের আইপিএল। তা নিয়ে ঝুলন মুখ না খুললেও প্রথম মরসুমে তাঁকে খেলতে দেখতে চান ভক্তেরা। মেয়েদের আইপিএলের সরকারি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত ঝুলন এ বিষয়ে মুখ খুলবেন না। তবে আইপিএল খেলার সিদ্ধান্ত নিলে বাংলা দলের হয়ে ম্যাচ খেলে নিজেকে তৈরি করে তুলতে পারেন তিনি।

 

নিবন্ধকারঃ ঋদ্ধি রিত

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...