আটত্রিশেও 'এক্সপ্রেস'

রায়বেরিলির এক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ১৯৯৯। মিতালী রাজ সদ্য ইন্ডিয়া ক্যাপ পেয়েছেন, ওই ম্যাচটিতে ওপেন করতে নেমেছেন। বল হাতে চাকদা থেকে উঠে আসা এক মেয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে গতি দিয়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়া মেয়েটির হাত থেকে বের হল একটা বিষাক্ত ডেলিভারি। স্তম্ভিত মিতালী দেখলেন তাঁর স্টাম্প উপড়ে গিয়েছে প্রথম বলেই!

 

মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেটের একটি ঘরোয়া প্রতিযোগিতা। ১ ওভারে মাত্র ২ রান দরকার বিপক্ষের। কিন্তু না হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী তো নয় এই মেয়ে। ওই ওভারটি দেয় মেডেন। শোনা যায় ওই ওভারে ছটা বলই অফ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার বেশ কিছু মুহূর্ত পরে নেমেছিল ব্যাটসম্যানের ব্যাট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই...

২০২১ মার্চ। দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ভারত মহিলা দলের প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচ। দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্য মাত্র ৬ রান চাই। হাতে ৬৬ খানা বল। প্রথম বল ৪। কিন্তু পরের ৩ বলে কোনও রান নয়। পঞ্চম বলে ১ রান, ওভারের শেষ বলে উইকেট!
৩৮ বছর বয়সেও একই রকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ! তার ওভারে জয়ের রান কোনওভাবেই হতে দেবে না! সিরিজ টি ভারতীয় দল হেরে গেলেও সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী? ঝুলন গোস্বামী...

 

JhulanGoswami1

পথ কি খুব মসৃন ছিল?
ছোটবেলায় ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে দ্রুত বল করার অভ্যাস শুরু। কারণ ছেলেরা প্রথমদিকে অভিযোগ তুলত মেয়েদের এত ধীরে বল তারা খেলবে না! এরপর ক্রিকেট খেলার জন্য রোজ চাকদা থেকে পথ পেরিয়ে কলকাতা .. বাবা মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও!

 

খেলতে দেওয়ার জন্য কোচের বুঝিয়ে রাজি করানো আত্মীয় পরিজনদের...সেখান থেকে মহিলাদের ওয়ান ডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি! আসলে ঝুলন গোস্বামী বাইশ গজের তিনকাঠিকেই জীবনের লক্ষ্য করে এগিয়েছেন যে...

ভারত পাকিস্তান যে কোনও ম্যাচেই হয় তীব্র উত্তেজনা! সেখানে ২০১৭ বিশ্বকাপে কী দেখলাম? পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার কাইনাত ইমতিয়াজ ইনস্টাগ্রামে ঝুলনের সঙ্গে ছবি শেয়ার করে লিখলেন যে, তিনি আপ্লুত যার খেলা দেখে, ছোট থেকে বড় হয়েছেন এবং ক্রিকেটকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন তার সামনাসামনি হতে পেরে.. চাকদার ঝুলন তো শুধু বাংলা বা ভারত নয়, উপমহাদেশের প্রতিটা মেয়ে যারা ফাস্ট বোলার হবার স্বপ্ন নিয়ে ঘাম ঝরিয়ে চলেছে, তাদের করেছেন উজ্জীবিত...

 

JhulanGoswami2


তখন ১৫ বছর বয়স। জীবনের প্রথম প্র‍্যাকটিস ম্যাচেই এক ওভার বল করে হাঁপিয়ে যায় মেয়েটি। আশেপাশে সতীর্থরা সেটি দেখে উপহাস করছিল। আর সেই মেয়েটিই কিনা পরবর্তীতে হলেন বিশ্বের সবেচেয়ে দ্রুতগতির নারী বোলার।
হ্যাঁ। ঝুলন। ভারতের ফাস্ট বোলার। পশ্চিমবাংলার গর্ব-চাকদহ এক্সপ্রেস, ঝুলন গোস্বামী।

নিজের প্রতি প্রচণ্ড রকমের আত্ববিশ্বাস আর জয়ের তাড়না থেকেই মেয়েটি পায় জীবনের সেরা সফলতা। ২৫ নভেম্বর ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের চাকদহ নামে ছোট গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম ঝুলনের। বড় হন পিসির কাছে। ফুটবলের বড় ফ্যান ছিলেন। তবে টেলিভিশনে ১৯৯২ বিশ্বকাপ দেখার পরই স্বপ্ন বোনেন বড় ক্রিকেটার হওয়ার। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে প্রতিদিন ভোরে উঠতেন অনুশীলনের জন্য।
 চাকদহ থেকে প্রতিদিন ভোরে ট্রেনে করে যেতেন কলকাতা। সারাদিন অনুশীলন শেষে ভীড়ের মধ্যেই কষ্ট করে বাড়ি ফিরতেন।

প্রতিদিনই চলত একই রুটিন। প্রথমদিকে বাবা-মা সঙ্গে গেলেও, একটা সময় পর একাই যেতে আসতেন অনুশীলনে। মেয়ে মানুষ ক্রিকেট খেলবে সেটা তখনও বিস্ময়ের! সেসময় বাড়ির বাইরে পা রাখা যেখানে দুরূহ বিষয় মেয়েদের জন্য, সেখানে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার কথা যেন হিমালয় পর্বতে চড়ার থেকে কম কিছু না।

সবকিছু ছাপিয়ে পরিবারের অমত-বাধার পরেও ভোরবেলা মেয়েটি চলে যেতেন অনুশীলনে। বাইরে যারা দেখতেন অবশ্য সবাই অবাকও হতেন। অনেকে বলতেন, এতটুকু বয়সে একা একা এই মেয়ে কোথায় যায়। ক্রিকেটের কথা শুনে অনেকেই বলত এসব ছেড়ে পড়াশুনায় মন দিতে।


JhulanGoswami3

১৯৯৭ বিশ্বকাপে অজি ব্যাটার বেলিন্ডা ক্লার্কের ব্যাটিং দেখার পর ক্রিকেটার হবার ঝোঁকটা আরো বাড়ে। অপেক্ষায় ছিলেন সুযোগের। কারণ সুযোগ সবার জীবনেই কম বেশি কোনও না কোনও সময় আসে৷ পর পর দু’বার সেই মেয়েটিও পেয়ে যায় বড় সুযোগ।

অনূর্ধ্ব-১৬ ভারতীয় মহিলা দলের হয়ে খেলার সুযোগ আসলেও যোগাযোগের অভাবে খেলা হয়নি তার। কারণ তার বাড়িতে তখন ফোন ছিল না তাদের। পরে অবশ্য অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার ডাক পান, কিন্তু ভাগ্য সেবারও সহায় হয়নি। বাদ পড়েন সেখান থেকেও।

জীবনের এই কঠিন যুদ্ধে পিছপা না হয়ে শুরু করেন আরও কঠোর অনুশীলন। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সর্বপ্রথম ডাক পান বেঙ্গল ক্রিকেট দলের হয়ে খেলার। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে শেষে জায়গা পান অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা দলে। সেখান থেকে যে শুরু আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

১৯ বছর বয়সেই চেন্নাইতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় জাতীয় নারী দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার। এরপরই শুরু অন্য ইতিহাস লেখনের পর্ব। ভারতীয় জার্সি গায়ে জড়িয়ে নিজেকে নিয়ে যান একের পর এক মাইলফলকে। নিজের গতিময় বোলিংয়ের কারণে নাম পান ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’ হিসেবে।



JhulanGoswami4


একই বছর ১৪ ই জানুয়ারি ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই অভিষেক হয় টেস্টে ক্রিকেটে। লখনউতে খেলেন নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচ। ঝুলন ২০০৬-০৭ সনে মিথালি রাজের ডেপুটি হিসেবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয় পায় ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নেমে অর্ধশতক করার মাধ্যমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে৷ ইংল্যান্ডের৷ মাটিতে মহিলা দলকে প্রথম জয় এনে দেন ঝুলন। লিস্টারে সেই টেস্টে ৭৮ রানে নেন ক্যারিয়ার সেরা ১০ উইকেট।

২০০৭ সালে আফ্রিকা-এশিয়া টুর্নামেন্টে ঝুলন এশিয়া দলের সদস্য ছিলেন। একই বছর আইসিসির উইমেন্স ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন ঝুলন গোস্বামী। ২০০৮ সালে দায়িত্ব পান জাতীয় দলে অধিনায়কত্বের। তার নেতৃ্ত্বে ২৫ টি ওয়ানডে খেলে ভারতীয় নারী দল। ২০১০ সালে অর্জুন এওয়ার্ড পান তিনি। এরপর ২০১২ সালে দিনা এডুলজির পর দ্বিতীয় নারী ক্রিকেটার হিসেবে পান পদ্মশ্রী পদক।

ক্যারিয়ারে সর্বমোট ২৭২ টি ম্যাচে উইকেট শিকার করেন ৩৪০ টি। তিন হাফ সেঞ্চুরি করেন ১৭৬৪ রান৷ টেস্টে ১২ ম্যাচে শিকার করেন ৪৪ উইকেট (৩বার পাঁচ উইকেট)। মেয়েদের ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১৮ সালের সাত ফেব্রুয়ারি প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ২০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। ১৯২ ওয়ানডেতে দুইবার ৫ উইকেট ও সাতবার ৪ উইকেটে মোট উইকেট নেন ২২৫ টি। ২০১১ সালে একদিনের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ হারলেও ৩১ রানে ৬ উইকেট শিকার করেন ঝুলন। টি-টোয়েন্টিতেও ৬৮ টি ম্যাচে নিয়েছেন ৫৬ উইকেট।

২০১৮ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলে অবসর গ্রহণ করেন ৩৮ বছর বয়সী ঝুলন গোস্বামী। ভারতীয় জাতীয় দল ছাড়াও তিনি উইমেন্স টি-টোয়েন্টি লিগে ট্রেইলব্রেজার্সের হয়ে খেলেছেন দুই সেশন।

২০১৭ তে উইমেন্স ওয়ার্ল্ডকাপে ফাইনাল খেলে ভারত নারী দল। সে দলের সদস্য ছিলেন ঝুলন। তবে ফাইনালে ইংলিশদের কাছে ৯ রানের হারে স্বপ্নভঙ্গ হয় বিশ্বকাপ জয়ের। ঝুলন গোস্বামীর শূন্য থেকে চাকদহ এক্সপ্রেস হয়ে ওঠার বায়োপিক তৈরি করছেন ডিরেক্টর সুশান্ত দাস৷

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০১৮ সালে নিজের ৩০০ তম আন্তর্জাতিক উইকেট শিকার করেন ঝুলন। সম্প্রতি (২০১১-২০২০)দশক সেরা উইমেন্স ওয়ানডে একাদশে জায়গা পান তিনি।

নিজের দুর্দান্ত বোলিং আর লিডারশিপে ভারতীয় মহিলা দলকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। সাধারণ ঘর থেকে উঠে এসে বিশ্বকে দেখিয়ে দেন মেয়েরাও পারে। ঝুলন শুধু বোলিংয়ে নয় ব্যাটিংয়েও ছিলেন বেশ পারদর্শী। শুধু খেলাধূলায়ই নয় বরং ছাত্রী হিসেবেও তিনি ছিলেন বেশ মেধাবী। তিনি একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী। বর্তমানে তিনি ড. ঝুলন গোস্বামী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...