ঝাড়গ্রামের রামেশ্বর মন্দির

অরণ্য সুন্দরী হল ঝাড়গ্রাম, শালের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ঝর্ণার কলতান, সুবর্ণরেখা-ডুলং-তারাফেনি নদীর প্রবাহ এক অপার সৌন্দর্য্যের ভান্ডার। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, সবুজের আহ্বান আর ধামসা-মাদলেরমনকাড়া সুরে অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রাম ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে এক মনোমুগ্ধকর পর্যটনকেন্দ্র। ঝাড়গ্রামের ডাঙ্গা-ডহর-ডুংরিতে চারিদেকে ছড়িয়ে অসংখ্য ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক, ধর্মীয় ও নৈস্বর্গিক নান্দনিক নিদর্শন যা ভ্রমনপিপাসু পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়। স্বাগত অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রামে সবুজের আহ্বানে।

সুবর্ণরেখা নদীর তীরেই রয়েছে রামেশ্বর মন্দির। এই মন্দির সুপ্রাচীনকাল থেকে ইতিহাস, ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। রামেশ্বর মন্দিরটি ঝাড়গ্রাম জেলার ধনকামড়ায় অবস্থিত। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে লোধাশুলি জঙ্গল পেরিয়ে এসে, কিছুটা এগিয়ে বাম দিকে বেশ কিছুটা এগোলে পড়বে গোপীবল্লভপুর। সেই গোপীবল্লভপুর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ধনকামড়া। সেখানেই সুবর্নরেখা নদীর একেবারে পাশেই অবস্থিত রামেশ্বর মন্দির। মন্দিরের বর্ণ সাদা। জনশ্রুতি রয়েছে, ওই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং শ্রী রামচন্দ্র। রত্নাকরের লেখা রামায়ণেও এর উল্লেখ রয়েছে। অযোধ্যার রাজ রামচন্দ্র, বনবাসে থাকাকালীন বাংলার মাটিতেও দিন কাটিয়েছিলেন তিনি। বাংলায় অবস্থিত ঝাড়গ্রামের এই মন্দিরই প্রমাণ করে দেয় যে, অযোধ্যার রাজা শ্রী রামচন্দ্রের সঙ্গে বাংলার যোগ নতুন নয়।

মন্দিরের গর্ভগৃহে দ্বাদশ শিবলিঙ্গ রামেশ্বর রুপে বিরাজমান। রামচন্দ্রের ১৪ বছরের বনবাস কালে নির্মিত হয়েছিল এই রামেশ্বর মন্দির। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী শোনা যায়, রামচন্দ্রের বনবাস কালে গভীর অরন্যের মাঝে এইখানেই পত্নী সীতা ও ভ্রাতা লক্ষণের সঙ্গে রামের সাক্ষাৎ হয়। দিনটি ছিল শিব চতুর্দশী। প্রতিবছর শিব চতুর্দশী পালন করা হয় এই মন্দিরে। প্রাচীনকাল থেকেই মেনে আসা হয়, এই শিবচতুর্দশীর দিনেই মাতা পিতার জন্য এই মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল। তাই এই মন্দিরে আজও শিবচতুর্দশী পালন করা হয়।

বহুল প্রচারিত রামের বনবাসের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে বাংলার এই মন্দিরেও। স্ত্রী সীতার সঙ্গে বনবাসে থাকাকালীন বাংলার জঙ্গলে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র। এই বাংলার মাটিতেই রামের স্মৃতিবিজোড়িত সেই মন্দির আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিয়মিত পূজার্চনাও হয়ে থাকে মন্দিরে। জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও, এই মন্দিরে পর্যটকদের আনাগোনাও কিছু কম হয় না।

মন্দিরের পুরোহিতদের থেকে জানা যায় যে ১৪ বছরের বনবাসকালে বাংলার ভূমিতে অবস্থিত এই জঙ্গলে সময় কাটিয়েছিলেন সস্ত্রীক শ্রী রামচন্দ্র। ওই সময়কালের মধ্যে একদিন শিব চতুরদর্শী তিথি পড়েছিল। সেই দিন স্ত্রী সীতার জন্য সুবর্নরেখা নদীর বালি দিয়ে ১২টি শিবলিঙ্গ তৈরি করেছিলেন রাজা দশরথ পুত্র রাম। সেই শিবলঙ্গের সামনেই শিবরাত্রী ব্রত করেছিলেন মা সীতা। পরে পত্নীর অনুরোধে সেখানে শিব মন্দির নির্মাণ করেন রামচন্দ্র। পরে যা রামেশ্বর মন্দির নামে পরিচিতি পায়। ওই মন্দিরের পাশে ১২২১ সালে আরও একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। উড়িষ্যার রাজা ওই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সেই কারণে দ্বিতীয় মন্দিরে উড়িষ্যার নানাবিধ শিল্পকর্ম, স্থাপত্যরীতি চোখে পড়ে।

মহাসমারোহে শিবরাত্রি পালিত হয় মন্দিরে, শিবচতুর্দশী থেকে তিনদিন মেলা হয়। প্রচুর মানুষের সমাগম হয়ে। শিবরাত্রির দিন ব্রত পালনের জন্য আশেপাশের গ্রাম এবং বাইরে থেকে অগুনিত ভক্ত সমাগম হয়। বিভিন্ন জেলা ও রাজ্যের ভক্তেরাও পাড়ি জমান এখানে।

বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই মন্দির মন্দিরের পাশেই রয়েছে ৫০০ বছরের পুরানো একটি কাঁঠাল গাছ। রামেশ্বর মন্দিরের শিবপুজোর সাথে সাথে সাথে এই কাঁঠাল গাছটিকেও নিত্য পুজো করা হয়।

যদিও মন্দিরের প্রধান উপস্য দেবতা হলেন ভগবান শিব। শ্রাবন মাসে হাজার হাজার পূর্ন্যার্থী এখানে সম্মিলিত হয়ে ভগবান শিবের আরাধনা করে। নয়াগ্রামের রাজা চান্দ্রাকেতু মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, শোনা যায় অনুমানিক ষোড়শ শতকের কাছাকাছি সময়ে মন্দিরটির নির্মাণ করা হয়েছিল। মন্দিরটি ঐতিহ্যবাহী উড়িয়া স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। প্রতি বছর গঙ্গাবারুনীর সময় মন্দির সংলগ্ন মাঠে একটি বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়। এই মন্দিরের চিত্তাকর্ষক দৃশ্য ও ইতিহাস সর্বদাই পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...