‘উড়ন্ত শিখ’ মিলখা

তাঁর জীবন টানাপোড়েন আর ভাঙাগড়ায় গড়া। বড় ঘটনার সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে, তা উপমহাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের সবথেকে ট্র্যাজিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশবিভাগ বা পার্টিশন। যে ভয়ানক চড়াই-উৎরাই তাঁকে পেরোতে হয়েছিল, সে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের ছিন্নমূল কোটি কোটি মানুষকে যেতে হয়েছিল। তাই তিনি যখনই ভিকট্রি স্ট্যান্ডে সবথেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সাফল্যের পদকটি গলায় ঝুলিয়েছেন, সেই সাফল্য আসলে কোটি কোটি ছিন্নমূল মানুষের হয়ে দাঁড়িয়েছে। জয়ী হয়েছে ছিন্নমূল ভারত। তিনি মিলখা সিং।

 

MilkhaSingh1

 

মিলখা সিংয়ের জীবনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে পাকিস্তান। তাঁর গ্রাম গোবিন্দপুরা। পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রভিন্সের অন্তর্গত। ভাগ মিলখা ভাগের সেই ভয়ানক দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। আক্রান্ত পুরো মিলখার পরিবার। পালাতে গিয়ে কাদায় আছাড় খায় বালক মিলখা। জল জমে মাটির কাদা নয়, রক্তভেজা মাটিতে পা হড়কে যায় মিলখার। মিলখা সিংয়ের আত্মজীবনী ‘রেস অফ মাই লাইফ’ পড়ুন, সেখানে সেই ভয়ার্ত দিনগুলির বিবরণ রয়েছে। কিন্তু এই ভয়ার্ত অতীত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মিলখাকে আজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। ১৯৬০ গুডউইল গেমসে অংশগ্রহণের জন্য পাকিস্তানে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে মিলখা প্রথম অবস্থায় পাকিস্তান যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।

 

MilkhaSingh2

 

নেহরুর অনুরোধে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে সে দেশের সেরা দৌড়বীর আব্দুল খালেককে ৪০০ মিটার দৌড়ে পরাজিত করেন। রেস শেষে পাকিস্তান চিফ জেনারেল আইয়ুব খান মিলখা সিংকে ‘ফ্লাইং শিখ’ বা ‘উড়ন্ত শিখ’ নামে অভিহিত করেন, যা মিলখা সিংয়ের নামের সঙ্গে আজীবন রয়ে যায়। এখানেও পাকিস্তান যোগসূত্র রয়ে যায়। তাই একথা বলা হয় যে, পাকিস্তানের সেই রেস ঘিরে উভয় দেশেই মিডিয়ায় যে চর্চা মিলখা সিং পেয়েছিলেন, তা ছিল অভূতপূর্ব। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শাসকের থেকে স্বীকৃতি প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে তাঁর জীবনে একটি বড় প্রাপ্তি ছিল। তবে তা অতীত জীবনের ক্ষততে কতখানি মলম লাগাতে সক্ষম হয়েছিল, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

 

দেশভাগের পরে শরণার্থী জীবন কিছুদিন কাটানোর পরে চতুর্থবারের চেষ্টায় সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ হয় এই কিংবদন্তি অ্যাথলিটের। সেনাবাহিনীতে তাঁর যোগদান জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তাঁর জীবনে যুক্ত হয়েছিল নতুন একটি শব্দ― ‘শৃঙ্খলা’। যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মিলখার সঙ্গ ছাড়েনি। এত কিছু করেও ৬০ এর দৌড়ের দুঃখ তাঁর জীবন থেকে যায়নি।

 

MilkhaSingh3

 

১৯৫৮ সালে ন্যাশনাল গেমস, এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসে ২০০ এবং ৪০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতে দেশকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন দীর্ঘদেহী পাঞ্জাবী মিলখা। দেশভাগের সময়ে উদবাস্তু হয়ে পড়া, অনাথ মিলখার দৌড়ের ময়দানে উত্থানের কাহিনী উজ্জীবিত করছিল দেশের তরুণ যুব সমাজকে।

 

১৯৫৮ সালে দুরন্ত পারফর্ম্যান্সের জন্য ভারত সরকার মিলখা সিংকে দিল ক্রীড়াজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘পদ্মশ্রী’। এই পরিস্থিতিতে ১৯৬০ সালে রোমে বসল অলিম্পিকের আসর। ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করলেও পদক অধরা ছিল মিলখা’র। তাই রোম অলিম্পিক হয়ে উঠল মিলখার পাখির চোখ। ২০০ এবং ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে অন্যতম ফেভারিট হিসেবে অংশগ্রহণ করলেন তিনি- আপামর ভারতবাসী যেন অপেক্ষায় ছিল মিলখার জয়ধ্বনির জন্য।

 

রেস শুরু হবার প্রথম ল্যাপেই যেন নিজের ডানা মেলতে শুরু করলেন ফ্লাইং শিখ। বিশ্বের বিখ্যাত স্প্রিন্টার ওটিস ডেভিস, কার্ল কফম্যানদের পাশে যেন ট্র‍্যাকের ওপর নিজের গতির ঝলক ছড়িয়ে দিতে থাকলেন মিলখা। প্রথম ২৪-২৫ সেকেন্ডের মাথায় যখন পদক প্রায় নিশ্চিত তখনই পথভ্রষ্ট হলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যাথলিট।

 

MilkhaSingh4

 

দৌড়ের ২৫০ মিটারের মাথায় হঠাৎ যেন তাঁর বিদ্যুৎ গতিকে শ্লথ করে দিলেন; কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে যেন ভ্রান্ত চিন্তা ঘিরে ধরল তাঁকে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মিলখা কয়েক মুহুর্তে পিছিয়ে গেলেন চতুর্থ স্থানে। সম্বিত ফিরতেই ফের মরণপণ দৌড় শুরু করলেন মিলখা কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

 

মাত্র ০.১ সেকেন্ডের ব্যবধানে তিনি শেষ করলেন চতুর্থ স্থানে। মিলখা দৌড় শেষ করলেন ৪৫.৭৩ সেকেন্ডে- ভারতীয় ক্রীড়ায় লেখা হল নতুন ইতিহাস। প্রথমবার কোনও ভারতীয় অলিম্পিকের মঞ্চে ন্যুনতম সময়ে শেষ করলেন দৌড়। কিন্তু স্বপ্ন ছোঁয়া হল না মিলখার। এই দুঃখ তাঁকে সারা জীবন তারা করে। বেরিয়েছে। অপেক্ষা করছেন কেউ তাঁর জায়গা পূরণ করবে হয়নি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...