“না না আজ রাতে আর যাত্রা দেখতে যাব না”। এই গান থেকেই বোঝা যায়, যে যাত্রা সাধারণত সারারাত ধরে অভিনীত হয়ে থাকে। গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বলের মানুষ বাড়ি থেকে রাতের আহার সমাপ্ত করে মঞ্চের সামনে নিজের নিজের বসার আসন নিয়ে হাজির হয়ে যায়। ভোর পর্যন্ত চলে সেই যাত্রানুষ্ঠান। যে কোন যাত্রাপালার সময়সীমা প্রায় চার ঘন্টার মতো হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সময় আরও দীর্ঘতর হয়।
শোভাযাত্রা, মিছিল থেকে যাত্রার পথচলা। বিভিন্ন উৎসব ও পূজা-পার্বণের সময় গ্রাম অথবা নগরের এক শ্রেণীর নৃত্য-গীত জানা লোক সকলকে আনন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নানা রঙের পোশাক পরিচ্ছদের বহু-বিচিত্র সমারোহে ও অঙ্গভঙ্গি করে পথে পথে ঘুরত। তাদের এই প্রদক্ষিণ থেকে হয়তো “যাত্রা” শব্দটি এসেছে মনে করা হয়।
পরিক্রমার পথে দশর্কদের নাচ-গান-অভিনয় দেখানোই ছিল যাত্রার মুখ্য উদ্দেশ্য। তারপর এল পরিবর্তন। ঘুরে ঘুরে নাচ-গান-অভিনয় বন্ধ হল। তৈরি হল আসর। তবে আগের নামটি রয়ে গেল। যাত্রা নামই পরিচিতি পেল।
ইতিহাসের পথ বেয়ে যাত্রা আজ নাগরিক সমাজের বিনোদন মাধ্যম হয়ে উঠেছে। অতীতের ধূলি মাখা পথ ধরে তার চলা। প্রথমদিকে যাত্রা শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, ধর্মের অনুষঙ্গও ছিল। ষোড়শ শতকে চৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি আন্দোলনের সময়ে যাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাসলীলা, জয়দেবের “গীতগোবিন্দ”, চন্ডীদাসের “ শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” নাট্যগীতকে যাত্রার আদি রূপ মনে করা হয়।
চৈতন্য পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামী রামানন্দ রাই এবং রূপ গোস্বামী কৃষ্ণ জীবনী নির্ভর পালা রচনা করতেন। সেগুলো আবার অভিনয়ও করা হত। এর পাশাপাশি পৌরাণিক পালা রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের কাহিনি নিয়ে অভিনয় হতে থাকে। “চন্ডী মঙ্গল”, “বেহুলার ভাসান” যাত্রার মাধ্যমে অভিনীত হত।
ঊনিশ শতকের আগে যাত্রায় মহিলা প্রবেশ একদম ছিল না। ঊনিশ শতক থেকে যাত্রায় মহিলারা অভিনয় করা শুরু করে। যে মেয়েরা যাত্রায় অভিনয় করতে আসত তারা বেশির ভাগই খুব কম বয়সের হত। দলে সর্বক্ষণ থেকে তাঁরা অভিনয় শিক্ষা গ্রহণ করতেন। যাত্রায় মঞ্চ সাধারণত চারিদিক খোলা হয়। যাত্রায় গলার স্বরের একটা বড়ো ভূমিকা রয়েছে। একদম শেষের দর্শক যাতে সংলাপ শুনতে পায় সেকারণে যে কোনও সংলাপই জোরে বলার রীতি। এছাড়া চড়া সুরের গান, চড়া আলো ব্যবহার যাত্রায় লক্ষ্যণীয়।
মঞ্চের উপরই সাধারণত সঙ্গীতশিল্পীরা বসে। ঢোল, পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম তবলা, বাঁশি, বেহালা বিভিন্ন ধরণের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। দৃশ্য অনুযায়ী সুরের প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া মঞ্চের দুদিকে থাকে প্রবেশ দ্বার। প্রবেশ দ্বার মুক্ত হয়। দর্শকদের মধ্যে থেকেই শিল্পীরা মঞ্চে উঠে আসেন। নাচ, গান, সংলাপের এক জম-জমাট মিশেল হল যাত্রা। যাত্রায় একজন বিবেকের চরিত্র অভিনয় করে। ঠিক-ভুল, ন্যায়-অন্যায় কথা সে অভিনয়ের মাঝে মাঝে এসে বলে যায়।
সেপ্টেম্বর মাসকে যাত্রা শুরু হওয়ার মরসুম ধরা হয়। ঐ সময় থেকে শুরু করে দুর্গাপুজো এবং শীত পর্যন্ত চলে যাত্রার অভিনয়। পুজো বাড়িতেও যাত্রা অভিনীত হয়ে থাকে। গ্রামে-গঞ্জে যাত্রাদল ঘুরে ঘুরে তাদের পারফরম্যান্স করে।
বিংশ শতকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সচেতনা বৃদ্ধির জন্যও যাত্রা ব্যবহার করা হত। রাজনৈতিক মতাদর্শ গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার ছিল যাত্রা। ভারতীয় গণনাট্য সংঘও যাত্রাকে তাঁদের মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
১৯৬১ সালে “প্রথম যাত্রা উৎসব” চালু হয়। ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ প্রথম অভিনেতা যিনি যাত্রার জন্য সঙ্গীত নাট্য একাডেমি পুরস্কার পান।
আগে যাত্রাদল মূলত অভিনেতা-ম্যানেজার-গায়ক মিলে চালাত। বর্তমানে যাত্রা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এখন নির্দিষ্ট একজন মালিক থাকে যেকোন দলে। তিনিই পুরো দল নিয়ন্ত্রণ করেন। চিত্তরঞ্জন অপেরা, নট্য কম্পানি, ভারতি অপেরা, অগ্রগামী অপেরা, লোকনাট্য অপেরা, গানবানী অপেরা, নটরাজ অপেরা বিখ্যাত যাত্রাদল রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা যাত্রার রমরমা দেখা যায়। কলকাতার চিতপুরকে যাত্রাদলের গড় বলা হয়। বর্তমানে প্রায় তিনশোর মতো যাত্রার কোম্পানি আছে। প্রায় কুড়ি হাজার শিল্পী এই পেশার সঙ্গে যুক্ত।
রথের দিন থেকে যাত্রা পাড়ার বুকিং শুরু হয়। কোন যাত্রা আগামি ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠী বাংলা কাঁপাতে আসছে বিজ্ঞাপনে বেরিয়ে যায়। বর্তমানে যাত্রায় আর বিবেক দেখা যায় না। আছে নাচ-গান-লাস্য। আগে সখীর দল ছিল এখন সখীর দলও নেই।
ঐতিহাসিক বা পুরাণ নির্ভর পালার সংখ্যাও হাতে গোনা হয়। যা হয় সবই সামাজিক পালা। “রক্তে ধোঁয়া ধান“ যাত্রায় বৈজুর বিখ্যাত সংলাপ- “লে বিন্দিয়া লে, তু লাচ করবি/আমি ঢোল বাজাব” বা “লালবাঞ্জা”র বাখর খাঁয়ের সংলাপ- “কার এতো দুঃসাহস, কোন যুগে বাবা ঢোল বাজাত বলে আজও কে আমায় বলে বাখর ঢুলি”। পালাকারের কলমের ধার কমেছে, কমেছে নাটকীয়তা।
নয়ের দশকের শেষ দিক থেকে টিভি সিরিয়াল এবং সিনেমার প্রভাব যাত্রায় বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। তারফলে সামাজিক আবেদন আগের থেকে অনেকটাই কমে যায়। বদলে এসেছে চটকদারি ও সস্তায় বাজিমাতের কেরামতি। সিরিয়াল, সিনেমার নায়ক-নায়িকারা যাত্রায় অভিনয় করতে আসার ফলে যাত্রা শিল্পীদের প্রভাব অনেকটা কমে আসে। যাত্রার রূপও বদলে যায়। তাছাড়া টিভি সিরিয়াল, সিনেমা, রিয়েলিটি শোয়ের দাপটে যাত্রা প্রায় কোণঠাসা।
“তিতাস একটি নদীর নাম” উপন্যাসের শেষে শোনা যায় গ্রামে রাতে যাত্রাপালা হওয়ার কথা মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে লেখকের আক্ষেপ শহুরে নতুন সংস্কৃতি গ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতিকে গ্রাস করার ব্যথা।
যাত্রাকে নাগরিক সমাজ যেমন আপন করে নেয় নি ঠিক তেমনিভাবে গ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশও হয়ে উঠতে পারে নি। স্থূল চটকদার বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সে যেন এককোণে রয়ে গেছে। তবুও যাত্রার একটা আলাদা আবেদন রয়েছে যার জন্য আজও সে নিজের অস্তিত্ব বিনোদন মাধ্যমের ভীড়ের মাঝেও আলাদা করে জানিয়ে দেয়।