হিশাহিতো। বয়স মাত্র তেরো। মাত্র তেরো বছরের ছোট্ট কাঁধেই একটা গোটা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কারন তাঁর প্রজন্মে সেই একমাত্র পুরুষ।
গত আগস্টে ভুটান সফরে যান জাপানের সব চেয়ে কনিষ্ঠ রাজপুরুষ হিশাহিতো। তার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তার ঠিক কয়েক মাস আগেই হিশাহিতোর কাকা নেরুহিতো সিংহাসনে অভিষেক ঘটে। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে রাজ পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিচিতি করানোই ছিল ভুটান সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য।
পরনে হাকামা কিমানো, হাতে তির। এই দিয়ে সে সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে জীবনের প্রথম বিদেশ সফরেই।
জাপানের শাসন ব্যবস্থা রাজতন্ত্র সংবিধান সম্মত। রাজা আছে, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা প্রধান মন্ত্রীর হাতে। প্রধান মন্ত্রীকে নিয়োগ করেন রাজা। তবে রাজ পরিবার চাইলে রাজপদ সংক্রান্ত আইনে বদল আনতে পারে।
হিশাহিতো হলেন ক্রিসানথেমাম সিংহাসনের দ্বিতীয় উত্তরাধিকার। যুবরাজের বড় ভাই সম্রাট নারুহিতো চলতি বছরের মে মাসে সিংহাসনে আরোহন করেন।
জাপানের রাজপরিবারে বিগত ৪১ বছরের মধ্যে প্রথম পুরুষ সদস্য হিসেবে ২০০৬ সালে হিশাহিতোর জন্ম হয়। এই রাজপুত্র এখন জুনিয়র হাইস্কুলে পড়াশুনা করছেন।
আকিহিতোর সিংহাসন ত্যাগের পর তাঁর ছেলে যুবরাজ নারুহিতো জাপানের সিংহাসনে বসতে পারেন কেবল পুরুষরাই৷ নতুন সম্রাট হতে চলা নারুহিতোর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসাবে রয়েছেন তাঁর ছোটভাই আকিশোনো। নারুহিতো ও মাসাকো দম্পতির কোনো ছেলে নেই৷ এ কারণে আকিশিনোর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার তাঁর ছেলে যুবরাজ হিশাহিতো৷ বর্তমানে হিশাহিতোর বয়স ১৩ বছর৷
হিশাহিতের জন্মকে জাপানে অনেকেই ‘মিরাকল’ বলে মানেন। হিশাহিতোর ওপর এখন থেকেই প্রত্যাশার চাপ বাড়ছে। তাই জাপানী মিডিয়ার একটা অংশ এবং রাজনীতি বিদদের মতে এখন থেকেই তাকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা উচিত।
ছোট বয়স থেকেই মানুশের সঙ্গে মেশা, তাদের মন বোঝার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সে যে দায়িত্বভার বহন করতে চলেছে তার গুরুত্ব সম্পর্কে শুরু থেকেই সজাগ থাকতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
রাজপরিবারের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে জাপানের সংবিধানে সরাসরি কিছু উল্লেখ করা হয়নি এবং ইম্পিরিয়াল হাউসহোল্ড ল বা রাজপরিবার–সংক্রান্ত আইন হচ্ছে উত্তরাধিকারসংক্রান্ত বিষয়টি নিষ্পত্তি করে নেওয়ার ভিত্তি। সেই আইনে উল্লেখ আছে, একমাত্র পুরুষ উত্তরসূরিরাই সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হতে পারবেন। ফলে আইন অনুযায়ী নারী সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত।
যুবরাজ নারুহিতো একমাত্র কন্যাসন্তানের বাবা হওয়ায় পরবর্তী যুবরাজ হতে পারার যোগ্যতা এখন বর্তাবে বর্তমান যুবরাজের ছোট ভাই রাজপুত্র ফুমিহিতোর ওপর এবং সেই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে তাঁর পুত্র হিশাহিতো। নারী-পুরুষের সম–অধিকারে বিশ্বাসী জাপানের অনেকেই এটাকে দেখেছেন জাপানে নারীর সম–অধিকার অর্জিত হওয়ার পথে বড় একটা বাধা হিসেবে। সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে নারী-পুরুষের সম–অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার বিষয়টি অবশ্য জাপানে অনেক দিন থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে। সরকারি পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও কোনো রকম সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত গৃহীত না হওয়ায় রাজ সিংহাসনে মেয়েদের আসার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।
সরকার পরিচালনায় সম্রাটের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। তার পরও সম্রাট পদটি এখনো অনন্য মর্যাদার অধিকারী।আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক" হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
যুবরাজ হিশাহিতোর কোনও ‘মেন্টর’ নেই। ঠাকুরদা সম্রাট আকিহিতোর মেন্টরের কড়া প্রশিক্ষণে জীবন শুরু করেছিলেন।আকিহিতো জাপানের জনপ্রিয়তম সম্রাট ছিলেন। শান্তি, মৈত্রই স্থাপনের জন্য এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে বহু প্রসংশনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
হিসাহিতের মেন্টর কে হবেন বা হিশাহিতকে ঠিক কীভাবে গ্রুম করা হবে সেটাও স্পষ্ট নয়। কারণ রাজমুকুট মাথায় উঠলে তার দায়িত্ব কী হবে সেটাই এখন স্পষ্ট নয়।
হিসাহিত সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে রাজপাট চালাবে নাকি আইন পরিবর্তন করে রাজপরিবারের মেয়েদেরও রাজ ক্ষমতার উত্তরাধিকার দেওয়া হবে। তবে জাপানে রাজ পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী রাজ পরিবারের বাইরে সাধারণ কোনও নাগরিককের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলে রাজপরিবারের মেয়েদের রাজসম্পর্ক ত্যাগ করতে হয়। তারা সাধারণ নাগরিক হয়ে যান। প্রাক্তন সম্রাট আকিহাতোর একমাত্র কন্যা সায়াকো এবং পৌত্রি ম্যাকোর ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে।
হিশাহিতোর সিংহাসনে আরোহন নিয়ে জাপানে এখন দুটি মত স্পষ্ট। রক্ষণশীল গোষ্ঠী প্রথা মাফিক হিশাহিতোকেই পূর্ণ রাজ মর্যাদায় ক্ষমতায় দেখতে চান। আর মুক্ত ভাবনার মানুষরা চান ক্ষমতায় নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
আপাতত রাতারাতি উত্তর মেলার যখন কোনও সুযোগ নেই তখন জাপানের মানুষ চাইছেন সুস্থ তর্ক চলতে থাকুক, তাতে অধিকার রক্ষার কথাগুলো অন্তত বলার সুযোগ মিলবে।