কলকাতা হল আনন্দ নগরী। আমাদের তিলোত্তমা বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহু মানুষের বাস এখানে। স্মরণাতীত কাল থেকেই অনেকে এখানে আসছেন এবং মিশে যাচ্ছেন। মন্দিরের মন্ত্র উচ্চারণ, আজানের সুর আর গির্জার ঘণ্টার ধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয় এখানে।
দুর্গাপুজোর অঞ্জলি হোক বা ঈদের বিরিয়ানি আবার বড়দিনের কেক; সবকিছু নিয়েই এ শহরের জুড়িমেলা ভার। কলকাতার বুকে কালীমন্দিরের মা কালীর আরাধনা করেন চিনারা, চাউমিন-মঞ্চুরিয়ান ভোগ দেন। দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি সারেন মুসলমানরা। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আফগান, চিনি, আর্মেনিয়ান, ইহুদি সকলেই এখানে মিলেমিশে বসবাস করেন। প্রত্যেকে নিজেদের ধর্মাচরণও করেন।
তেমনই কলকাতার বুকেই রয়েছে জাপানিদের বৌদ্ধ মন্দির। যা জাপানিদের বৌদ্ধ মন্দির নামেই পরিচিত। নিপ্পনজান মায়োহোজি বৌদ্ধ মন্দির কলকাতার সবচেয়ে সুন্দর এবং ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা বৌদ্ধ মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম। এই মন্দিরটি দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার লেক রোডে অবস্থিত, যা এখন কবি ভারতী সরণি নামে পরিচিত। যদিও এই মন্দিরের উপস্থিতির কথা কিন্তু আজও বেশির ভাগ কলকাতাবাসীর কাছে অজানা। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিচিদাতসু ফুজি। নিচিদাতসু ফুজি ছিলেন জাপানি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নিচিরেনের এক শিষ্য, যিনি ছিলেন লোটাস ধর্মসূত্রের মতাবলম্বী। লোটাস সূত্র ভারতে প্রচার করার লক্ষ্যেই কিন্তু নিপ্পনজান মায়োহোজি বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবা হয়েছিল। এই মন্দিরে বৌদ্ধ ঐতিহ্যের নিদর্শন। এখানে নিয়মিতভাবে প্রার্থনা হয়। সকলের জন্যই মন্দির উন্মুক্ত।
ভাবাই যায় না, দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। এমন একটি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। মন্দিরটি আদপে জাপানিদেরি তৈরি। ঢাকুরিয়া লেক বা রবীন্দ্র সরোবরের গা ঘেঁষে নিপ্পনজান মায়োহোজি নামক জাপানি বুদ্ধ মন্দিরটি অবস্থিত। জাপানিদের বিশ্বাস, এই মন্দির বা মঠটি হল শান্তির আদর্শ স্থান। দক্ষিণ কলকাতার লেক রোডে অবস্থিত এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩১ সালে, বৌদ্ধধর্মের নিপ্পনজান মায়োহোজি বা নিপ্পনজান-মায়োহাজি-ডাইসাঙ্গা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুসরণে মন্দিরটি গড়ে তোলা হয়। বৌদ্ধধর্মের এই ভাগটি চালু হয় ১৯১৭ সালে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নিচিদাতসু ফুজি বৌদ্ধ ধর্মের এই বিশেষ ভাগটি প্রবর্তন করে। তিনি ছিলেন পদ্মসূত্রের রচয়িতা জাপানি সাধু নিচিরেনের যোগ্য শিষ্য। পদ্মসূত্র হল বুদ্ধের বাণী এবং শিক্ষার সংগ্রহ, যেটা বুদ্ধ তার জীবনের শেষদিকে বলতেন। নিচিরেনের স্বপ্ন ছিল, ভারতে এই পদ্মসূত্রের প্রচার করা। গুরুর এই স্বপ্ন সফল করতে, ১৯৩১ সালে নিচিদাতসু কলকাতায় আসেন। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৩৫ সালে। এই বৌদ্ধমন্দিরে মূলত নিপ্পনজান-মায়োহাজি-ডাইসাঙ্গা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষরাই আরাধনা করেন।
অপূর্ব সুন্দর এই মন্দিরের স্থাপত্যে জাপানি সংস্কৃতির ছাপ লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের প্রধান ফটক পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশের পর থেকেই দর্শনার্থীদের মন শান্ত হয়ে যায়। মন্দিরে ঢুকতেই চোখে পড়ে জাপানি ভাষায় লেখা কিছু কথা, বাংলায় যার তর্জমা করলে হয়, 'পদ্মসূত্রের এই অপরূপ জগতে আমি নিজেকে আত্মসমর্পণ করলাম'। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে অসীম শান্তি। কলকাতা এবং সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি বহু পর্যটক এই মন্দিরে আসেন। ভক্তরা ভগবান বুদ্ধের সামনে প্রার্থনার পর মোমবাতি এবং ধূপকাঠি জ্বালিয়ে যান মন্দির প্রাঙ্গণে। পুরো মন্দিরটিতে সাদা এবং সোনালি রঙের কারুকার্যে পরিপূর্ণ।
দোতলা মন্দিরের বাইরে ফুলের বাগান রয়েছে। মন্দিরের এক তলায় প্রার্থনা সভায় প্রার্থনা হয়। বাইরের দর্শনার্থীরা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এখানে প্রবেশের অনুমতি পান। প্রার্থনা হয় দুই বেলা, সকাল এবং সন্ধে। ভোর পাঁচটা নাগাদ প্রথম প্রার্থনা এবং সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ দিনের দ্বিতীয় প্রার্থনাটি হয়। প্রার্থনা কক্ষের বিশাল বেদীতে শ্বেত পাথরের বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। মূর্তিতেও জাপানি শিল্পকলার ছোঁয়াও স্পষ্ট। নিপ্পনজান মায়োহোজির দ্বিতীয় তলায় ধ্যান কক্ষ এবং আর্য ধর্ম গ্রন্থাগার রয়েছে। এখানকার লাইব্রেরিতে জাপানি সাহিত্যের অনেক বইও রয়েছে।
বুদ্ধ পূর্ণিমার সময় এই মন্দিরে সেজে ওঠে। সেই দিন মন্দিরে প্রবেশের অবাধ অনুমতি থাকে। পূর্ণিমার রাতে মন্দিরের সৌন্দর্য যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আসা বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মন্দিরের দায়িত্ব সামলান। প্রসাদ হিসেবে দর্শনার্থীদের বিস্কুট, ফল ইত্যাদি দেওয়া হয়।