তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুল ছাত্র। দিব্যি ডাকাবুকো। আর পাঁচটা বাচ্চার ভিড়ে মিশে থাকলেও আলাদা করে চোখ টেনে নেয় ছটফটে স্বভাবের জন্য।
পশ্চিম জাপানের কোবি স্কুলের প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে সে থাকবেই।
একদিন আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়ল সে। হাসপাতালে বেশ কিছু দিন।
একদিন তার মা তাকে জানাল, সে আর হাঁটতে পারবে না কোনওদিন। দু’পায়ের জোরে দাঁড়াতে পারবে না। খেলার মাঠ, ক্লাসরুমের হুটোপাটি, বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে দৌড় কিংবা অ্যারোবিক্সের মজা সবটাই অতীত। বছর ছয়েকের ছেলেটার বাকি জীবনের সব গতি হুইলচেয়ারে বন্দি। দু’চাকাতেই আটকা পড়ে গেল শৈশব।
মানতে পারেনি ছেলেটা। উথালপাতাল হয়ে কেঁদেছিল। কেন হারিয়ে গেল তার জীবন থেকে সব। মাঠ-রাস্তা-ক্লাসরুম- সাইকেল সব কিছু। সে মানতে পারেনি যে এবার থেকে তার জীবনটা অন্যপথে চলবে। তাকে ধরা হবে ‘বিশেষ’ শ্রেণিতে।
সেদিন থেকে সে সহানুভূতি আর দীর্ঘশ্বাসে খরচের খাতায় পড়ে যাওয়া মানুষ।
নিজেকে এই ভাবে দেখতে চায়নি ছেলেটা।
শুরু করেছিল অন্য লড়াই। সে যে ফুরিয়ে যাওয়ার নয়, সেই জাত চেনাবার লড়াই।
জাপানের কেনেতা কামবারা । পেশায় সিস্টেম ইঞ্জিনিয়র। নেশায় নৃত্যশিল্পী।
নিজের গল্প বলতে গিয়ে কেনেতা বলেন, সে দিনের সেই কান্নাই তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে স্বপ্ন আর একদিকে অসাড় পা। এই দু’য়ের মাঝখানে একমাত্র সেতু ‘হুইলচেয়ার’।
যে হুইলচেয়ারের জন্য তিনি মানুষের দয়া আর সহানুভূতির পাত্র, সেই হুইল চেয়ারই হয়ে উঠল বিশ্বজয়ের হাতিয়ার।
কেনেতা বলেন, কোনও বাধাই বাধা নয়। শুধু তোমাকে বাধা পেরনোর রাস্তাটা খুঁজে পেতে হবে।এক পথ না হলে বেছে নিতে হবে বিকল্প পথ। তবু স্বপ্ন থেকে সরে আসার ভাবনাটা মাথায় আনা যাবে না।
যেভাবে স্বপ্ন ছেড়ে যায়নি জাপানের এই নৃত্যশিল্পীকে।
২০২০ তে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হতে চলা প্যারা অলিম্পিকে অংশ নিতে চলেছেন তিনি। অলিম্পিকের উদ্বোধন এবং সমাপ্তি অনুষ্ঠানে দেখা যাবে তাঁকে নৃত্যশিল্পীর ভূমিকাতেই।
অন্যরকম হওয়ায় কোনও ভুল নেই। সব মানুষকে তিনি এই বার্তাই দিতে চান নিজের পারফরম্যন্সের মাধ্যমে।
জন্ম থেকেই স্পাইনা বিফিডা নামে স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত। কোমর থেকে শরীরের বাকি অংশ পুরোটাই অসাড়। সক্ষম শুধু শরীরের ওপরেই অংশ। হাত-কাঁধ এবং শরীরের ওপরের অংশে ভর দিয়েই পারফর্ম করেন।
৩৪ বছর বয়সী কেনেতা ২ বছরের এক শিশু কন্যার পিতাও।
কেনেতা বলেন, “ এখন মানুষ ‘বৈচিত্র্য’ নিয়ে খুব চর্চা করেন। কিন্তু নিজেদের জীবনে বৈচিত্র-এর অভিজ্ঞতা খুব একটা নেই। আমি তাদের ভাবাতে চাই ’’।
বারবার তাঁর পারফরম্যান্সের মাধ্যমে একটা কথাই বোঝাতে চান। তিনি বলেন হতে পারে আমার শরীরের গঠন অন্যরকম। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তা আকর্ষণীয় নয়। এই ভাবনাতেই মানুষকে ভাবাতে চান প্রতিবার। প্রতিটা অনুষ্ঠানের শেষে।
মাত্র পাঁচ বছর আগে নাচ শুরু করেন কেনেতা। এক বছর পর রিও প্যারা অলিম্পিকের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
প্রতিদিনের জীবনে চলতে চলতে হুইলচেয়ার কখনও কখনও কষ্টকর হয়ে উঠেছে কিন্তু সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে নাচ।
বিভিন্ন স্কুল কলেজ থেকে ডাক আসে কেনেতার কাছে। তাঁর লড়াইয়ের গল্প শুনতে চায় ছাত্রছাত্রীরা।
আগে অবশ দুটো পাকে রেখে-ঢেকে রাখতেন তিনি। আজকাল রাখেন না। ‘অক্ষমতা’কেআর আড়াল করতে চান না। ‘অক্ষমতা’ই যে তাঁকে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছে। নাচই বদলে দিয়েছে জীবন দেখার দৃষ্টি।