আজ স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম তিথি। ১৬০তম জন্ম তিথি উপলক্ষ্যে সিমলার পৈত্রিক নিবাসে বিশেষ পুজো চলছে। প্রাক সন্ন্যাস জীবনে তিনি ছিলেন নরেন্দ্রনাথ, উত্তর কলকাতার সিমলার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার অন্তর্গত দত্ত-ডেরিয়াটোনা বা দত্ত-ডেরেটোনা গ্রামের আদি নিবাসী ছিলেন তাঁরা। অনুমান করা হয় তাঁরাই ছিলেন ওই গ্রামের জমিদার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দত্ত-পরিবারের রামনিধি দত্ত তাঁর পুত্র রামজীবন দত্ত ও পৌত্র রামসুন্দর দত্তকে নিয়ে গড় গোবিন্দপুর গ্রামে চলে আসেন। নতুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণ শুরু হলে, ঐ এলাকার অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে দত্তরাও সুতানুটি গ্রামে উঠে আসেন। পরবর্তীতে সুতানুটিই হয়ে উঠেছে আজকের কলকাতা। সিমিলিয়া গাছের থেকে স্বামীজির পৈতৃক বাড়ির চত্বরের নাম হয় সিমলা। তাঁরা প্রথমে মধু রায়ের গলির একটি বাড়িতে থাকতে শুরু করতেন। ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটের যে বাড়িতে বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই বাড়িটি নির্মাণ করেন রামসুন্দর দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামমোহন দত্ত। রামমোহন দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্গাচরণ দত্ত ছিলেন বিবেকানন্দের পিতামহ। তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে একমাত্র পুত্র বিশ্বনাথ দত্তের জন্মের পর তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। স্বামীজির বংশের প্রথম সন্ন্যাসী ছিলে দুর্গাচরণ। দুর্গাচরণের পুত্র বিবেকানন্দের বাবা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত অ্যাটর্নি। বাংলা, ফারসি, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় অগাধ পান্ডিত্যছিল তাঁর। অ্যাটর্নিরূপে বিশ্বনাথ দত্তের খ্যাতি এবং পসার দুইই ছিল। সেই সঙ্গে ছিলেন দানশীল ও পরপোকারী। সিমলার নন্দলাল বসুর মেয়ে ভুবনেশ্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তিনি ছিলেন ভক্তিমতী এবং অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা। প্রথম কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু ও কন্যাসন্তানের জন্মের পর পুত্রসন্তান কামনায় তিনি তার এক কাশীবাসিনী আত্মীয়াকে দিয়ে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে নিত্য পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা করান। নিজে বীরেশ্বর শিবের আরাধনা শুরু করেন। এরপরই স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হওয়ায় ভাগবতী দেবীর বিশ্বাস হয় যে, তিনি শিবের কৃপায় পুত্রলাভ করেছেন। বিবেকানন্দের বাড়িতে এখনও বীরেশ্বর শিবের আরাধনা করা হয়। পিতার প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও মায়ের ধর্মপ্রাণতা নরেন্দ্রনাথকে বিবেকানন্দ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। নিজের মায়ের সম্পর্কে বস্টনে এক বক্তৃতায় স্বামীজি বলেছিলেন, তাঁর মা-ই নিঃস্বার্থ ভালবাসা এবং পবিত্রতামন্ডিত জীবনের দ্বারা তাঁকে সর্ব শ্রেষ্ঠ কর্মের যুগিয়েছেন, যার ফলে উত্তরকালে তিনি জন্ম সূত্রে প্রাপ্ত সংস্কার বশতই সন্ন্যাস জীবন বরণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
ছেলেবেলা থেকেই দুরন্ত ছিলেন খুব। দিদিমার ৯ নং রামতনু বসু লেনের বাড়িতেই তাঁর বেশির ভাগ সময় কাটতো। ক্ষেত্র গুহোর আখড়ায় মুগুর ভাজতেন, নব গোপাল মিত্রের ডেরায় যেতেন। মাদারির খেলা দেখতে ভালবাসতেন। ক্রিকেট কুস্তিতে পারদর্শী ছিলেন। রান্না করতেন, খেতেও ভালবাসতেন। বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, গানও গাইতেন। ছেলেবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার দিকে নরেন্দ্রনাথের আগ্রহ ফুটে ওঠে। এই সময় শিব, রাম, সীতা ও মহাবীর হনুমানের মূর্তির সামনে তিনি প্রায়শই ধ্যানে বসতেন। সাধুসন্ন্যাসীদের প্রতিও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ছেলেবেলায় বিবেকানন্দ অত্যন্ত দুরন্ত ছিলেন। তার পিতামাতার পক্ষে তাকে সামলানো মাঝে মাঝেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠত। তাঁর মা বলতেন, “শিবের কাছে ছেলে চাইলুম। তা তিনি নিজে না এসে পাঠালেন তার চেলা এক ভূতকে।” পরবর্তীতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সন্ন্যাস জীবন, বিশ্বজয়ী ভাষণ এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করে তিনি অমর হয়ে গিয়েছেন।
১৮৬৩ সালে ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের দিন উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রতি বছরের মতো আজও সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতেই স্বামীজির জন্ম তিথি পুজো আয়োজিত হচ্ছে। সকাল থেকেই মঙ্গলআরতির মাধ্যমে পুজোর শুভ সূচনা হয়েছে। সারাদিন ধরে আরাধনা চলবে। করোনার কারণে বিপুল ভক্তসমাগমের পরিস্থিতি নেই। ভক্তদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
বাণী ও রচনা, ২য় খণ্ডে স্বামী বিবেকানন্দ বলে গিয়েছেন, "বারবার আমি মৃত্যুর কবলে পড়িয়াছি, কতবার দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়াছে, কতবার পায়ে নিদারুণ ক্ষত দেখা দিয়াছে, হাঁটিতে অক্ষম হইয়া ক্লান্তদেহে বৃক্ষতলে পড়িয়া থাকিয়াছি, মনে হইয়াছে—এইখানেই জীবনলীলা শেষ হইবে। কথা বলিতে পারি নাই, চিন্তাশক্তি তখন লুপ্তপ্রায়। কিন্তু অবশেষে এই মন্ত্র মনে জাগিয়া উঠিয়াছে ও আমার ভয় নাই, মৃত্যু নাই, আমার ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই, আমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম। বিশ্বপ্রকৃতির সাধ্য নাই যে, আমাকে ধ্বংস করে। প্রকৃতি আমার দাস। হে পরমাত্মন, হে পরমেশ্বর, তােমার শক্তি বিস্তার করাে। তােমার হৃতরাজ্য পুনরাধিকার করাে। উঠো, চলাে, থামিও না। এই মন্ত্র ভাবিতে ভাবিতে আমি নবজীবন লাভ করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছি এবং আজ সশরীরে এখানে বর্তমান।"
সার্থক তাঁর জন্মদিন, নিজে বলতেন আরেকটা বিবেকানন্দ থাকলে বুঝতে পারত এই বিবেকানন্দ কী করে গেল। আজ পৃথিবী সংকটে এমন পরিস্থিতিতে ফের বিবেকানন্দকে দরকার আমাদের। তাঁর রচনায়, তাঁর কাজে, তাঁর মতাদর্শে তিনি আজও জীবত। বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের জন্ম তিথিতে তাঁকে চরণে সশ্রদ্ধ্য প্রণতি জানাই।