বাংলার নানা প্রান্তের জন্মাষ্টমী

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরেই বেশ কয়েকটি পার্বণ রয়েছে। তার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যা জন্মাষ্টমী নামে পরিচিত। এটি কৃষ্ণাষ্টমী ও গোকুলাষ্টমী নামেও এই উৎসব পরিচিত। বিভিন্ন পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথির উল্লেখ রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, সময়টা ছিল দ্বাপর যুগ। অসুররা চরম অত্যাচারী। তাদের অত্যাচারে সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দিন দিন অসুরদের অত্যাচার এতই বেশি হয়ে উঠে যে দেবদেবীগণ ক্ষীর সমুদ্র তীরে গিয়ে ভগবানের কৃপা প্রার্থনা করতে থাকেন। তাঁদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে শুধুমাত্র ব্রহ্মাকে অবগতির জন্য দৈববাণীতে বলে, "হে ব্রহ্মা, আমি খুব তাড়াতাড়ি যদুবংশীয় রাজাদের রাজধানী মুথরা রাজা সুরসেনের পুত্র বসুদেবের সন্তান রূপে দেবকীর অষ্টম গর্ভে আবির্ভূত হব। ধরিত্রী দেবসহ তোমরা আমার নির্দেশ অনুসারে দ্বারকা, মথুরা এবং ব্রজের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জন্মগ্রহণ করবে।" মথুরা, বৃন্দাবন, গোকুল আর দ্বারকার সীমানা ছাড়িয়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী অবধি ছড়িয়ে পড়েছে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথির উৎসব। বাংলাতেও মহাসমারহে এটি পালিত হয়। জন্মাষ্টমী উৎসবের ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণ বা গোপাল হয়ে উঠেছেন ভক্তের ভগবান। তিনি ভক্তদের ঘরের আপনজনে পরিণত হয়েছেন। 
 
জন্মাষ্টমী উৎসব ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালন করা হয়। দ্বাপর যুগে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ এই দিনই জন্ম নিয়েছিলেন। জন্মাষ্টমীর পৌরাণিক ইতিহাসের হদিশ করলে দেখা যায়, ভাগবত পুরাণেই প্রথম শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার রূপে বর্ণনা করে মর্ত্যধামে তাঁর জন্ম এবং বিভিন্ন লীলার কথা বর্ণনা করা হয়। পুরাণ মতে, মথুরার রাজা কংস নিজের বাবাকে কারাগারে পাঠিয়ে, রাজ-সিংহাসন দখল করেই অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। কংসের বোন দেবকীর সঙ্গে কংস বাসুদেবের বিবাহ হয়। বর কনেকে রথের উপর বসিয়ে গোটা রাজ্যজুড়ে শোভাযাত্রা করা হয়। রথের সারথী হয়ছিলেন রাজা কংস। রথ চলার সময় হঠাৎ করে এক দৈববাণী কংসের কানে বেজে উঠে, "ওরে নির্বোধ যাকে তুমি রথে করে নিয়ে যাচ্ছ, তাঁর গর্ভের অষ্টম সন্তান তোমাকে বধ করবে।" দৈববাণী শুনে কংস খড়গ হাতে দেবকীকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হন। বসুদেব কংসকে বলেন , তাঁদের সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরই কংসের হাতে তুলে দেবেন। একথা শুনে কংস ​দেবকী ও বাসুদেবকে কারাগারে বন্দী করেন। প্রহরীদের আদেশ দেন তাঁদের সন্তান জন্মালেই যেন কংসকে খবর দেওয়া হয়। একে একে দেবকীর ছয়টি সন্তানকে নৃশংসভাবে আছড়ে মেরে ফেলেন কংস। দেবকী তাঁর সপ্তম সন্তান দৈবশক্তির দ্বারা রোহিনীর গর্ভে স্থানান্তরিত করলে বলরামের জন্ম হয়। এরপর আসে শ্রীকৃষ্ণের পালা, দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কৃষ্ণ জন্ম নেওয়ার পর্ব। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি, রাতের প্রথম প্রহর। প্রবল ঝড়-জল বৃষ্টির মধ্যে কারাগার জন্ম নিলেন ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আকাশে দৈববাণী হল 'বাসুদেব তুমি এই সন্তানকে নিয়ে নন্দালয়ে রেখে এসো ও নন্দরানী যশোদা যে কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন তাকে নিয়ে এসো'।
 
বাসুদেব নন্দালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দৈবশক্তির প্রভাবে কারাগারের সব শিকল খুলে যায়, প্রহরীরা সবাই ঘুমে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে যমুনা উত্তাল হয়ে উঠেছে। বাসুদেব করজোড়ে প্রার্থনা জানাতেই যমুনা দুইভাগ হয়ে বাসুদেবকে রাস্তা করে দেয়। পুরাণে বলা হয়েছে, বিষ্ণু সপ্তমুখী নাগের রূপ নিয়ে যমুনার জল থেকে বাসুদেব এবং শিশু কৃষ্ণকে রক্ষা করেন। শিশু কৃষ্ণকে মাথায় করে বাসুদেব নন্দালয়ে যশোদার কাছে পৌঁছে তাঁর সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে নিয়ে মথুরায় ফিরে এলেন। সকালে শিশুর কান্নার শব্দে প্রহরীদের ঘুম ভাঙল। কংস এসে শিশুটিকে আছাড় দিতে গেলে, সে শূন্যে ভেসে হাসতে হাসতে কংসকে বলে 'আমি মহামায়া, তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে'। কৃষ্ণের জন্মকে কেন্দ্র করে বৃন্দাবনে নন্দালয়ে সবাই আনন্দে মেতে উঠেছিল, সেটাই 'জন্মাষ্টমী' নামে পরিচিত। নানান লীলার মধ্যে দিয়ে বালক কৃষ্ণ বড় হয়ে ওঠেন, মথুরায় তিনি মামা কংসকে বধ করেন।
 
সমগ্র ভারতে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান, ওড়িশা, তথা গোটা উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নানা স্থানে এবং ভারতের বাইরেও, ঘটা করে জন্মাষ্টমী পালিত হয়। মুম্বাই, নাগপুর ইত্যাদি স্থানে জন্মাষ্টমীর পরের দিন পালিত হয় 'দহি হাণ্ডি' নামে বিশেষ উৎসব পালন করা হয়। দই ভর্তি মাটির হাঁড়ি ফাটিয়ে সেই দই সমবেত ভক্তদের মাঝে প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। গুজরাতে দ্বারকায় একইভাবে 'মাখন হাণ্ডি' নামক এক উৎসব পালিত হয়। উত্তর ভারতে জন্মাষ্টমীর দিন শ্রীকৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন লীলার কাহিনী পালা বর্ণনা ও মূর্তি তৈরির চল রয়েছে।
 
বাংলায় নবদ্বীপে জন্মাষ্টমী শ্রীশ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী হিসেবেই পালিত হয়। পরেরদিন চলে নন্দোৎসব। ভক্তরা জমাষ্টমীর দিন উপবাস করেন, কৃষ্ণের উপাসনা করেন এবং ভাগবত পুরাণের দশম স্কন্দটি পাঠ করেন। গঙ্গায় রাধামাধবের বিগ্রহকে স্নান করিয়ে মধ্যরাত্রে নানাবিধ পদ সহযোগে ভোগ অর্পণ করা হয়। ​বৈষ্ণবতীর্থ শান্তিপুরের বিভিন্ন মন্দির ও পরিবারে আজও মহাড়ম্বরে পালিত হয় এই উৎসবটি। গোস্বামী বাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণভাবে জন্মাষ্টমী উদযাপিত হয়। এখানে জন্মাষ্টমীর আকর্ষণ হল ঝাল নাড়ু। চালের গুঁড়ো, ঘি, গোলমরিচ ইত্যাদি দিয়ে যা তৈরি করা। শান্তিপুরের অন্যতম প্রাচীন শ্যামচাঁদ মন্দিরে ঘটা করে জন্মাষ্টমী পালিত হয়। নাম সংকীর্তন চলে। দুপুরে অন্নভোগের পরে রাধারানিকে সরিয়ে রাখা হয়। নির্দিষ্ট তিথি ও আচার অনুষ্ঠান মেনে আঁতুরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পরে নাড়ি কাটা অনুষ্ঠিত হয়। পুরনো প্রথা অনুসারে সদ্যোজাত ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে যেমন তার নাড়ি কাটা হয় তেমনই গৃহদেবতার উদ্দেশ্যে হলুদ সুতো কাটা হয় চাঁচারি দিয়ে। শৈশবাবস্থার কথা ভেবেই রুপোর তৈরি বিভিন্ন খেলনা দেওয়া হয়। ১০০৮টি তুলসীপাতা চন্দন মাখিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। জন্মাষ্টমীর বিশেষ ভোগে থাকে তালের বড়া, লুচি, সুজি, পায়েস, মালপোয়া, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি। পরের দিন পালিত হয় নন্দোৎসব।
 
কাঁচরাপাড়া-কল্যাণীর কৃষ্ণরাই জিউর মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে আজও বহু ভক্তের সমাগম হয়। জন্মাষ্টমীর রাতে মন্দিরের পিছনে রন্ধনশালায় নারায়ণ শিলাকে নিয়ে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্মানুষ্ঠান, নাড়ি কাটা-সহ ধাপে ধাপে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। শোভাবাজার রাজপরিবারের গৃহদেবতা গোবিন্দজিউর ষোড়শোপচারে বিশেষ পুজো আজকের দিনে। গোবিন্দজিউর ভোগে থাকে খাস্তাকচুরি, রাধাবল্লভী, গজা, নিমকি, বালুসাই, লালমেঠাই, মতিচুর, তালের বড়া ইত্যাদি। রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিটের শ্যামসুন্দর জিউর ঠাকুরবাড়িতে নন্দোৎসবের এক অঙ্গ হল রাধারানির মানভঞ্জন। সকালে রাধারানিকে দোতলায় একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেলে শ্যামসুন্দর তাঁকে ভেট পাঠান। পরে রাধারানির মানভঞ্জনের জন্য শ্যামসুন্দরকেও দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় পরিবারের সদস্যরা গান করেন। পরে রাধিকার মানভঞ্জনের পরে যুগল মূর্তিকে এক সঙ্গে নীচে দালানে এনে সিংহাসনে স্থাপন করে আরতি করা হয়। এই সময়ে তালের বড়া, মালপোয়া ভোগ নিবেদন করা হয়। পোস্তা রাজবাড়ির রাজা সুখময় রায় প্রতিষ্ঠিত গৃহদেবতা শ্যামসুন্দর জিউর ঠাকুরবাড়িতে ১৫০ বছর ধরে জন্মাষ্টমী পালিত হয়ে আসছে। 
 
 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...