জামদানি শাড়ির জন্য বিখ্যাত সোনার গাঁ এবার বিশ্ব স্বীকৃতি পেল।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁকে ওয়ার্ল্ড ক্রাফটস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ‘ওয়ার্ল্ড ক্রাফট সিটি’র মর্যাদা লাভের জন্য ওয়ার্ল্ড ক্রাফটস কাউন্সিলের কাছে একটি আবেদন করা হয়। সম্প্রতি তা স্বীকৃতি পেল।
এই প্রথম বাংলাদেশের কোন স্থান ‘ওয়ার্ল্ড ক্রাফট সিটি’র মর্যাদা লাভ করল। জামদানি শিল্পের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য সোনারগাঁ-তে প্রতিবছর ‘জামদানি উৎসবে’র আয়োজন করা হয়।
পুরোনো জামদানি শিল্পকর্মগুলো পৃথিবীর বয়নশিল্পের ইতিহাসের একেকটি প্রামাণ্য দলিল।
প্রাচীনকাল থেকেই এই ধরনের কাপড় তৈরির জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় বরাবর পুরাতন সোনারগাঁ অঞ্চলটিই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট কেন্দ্র।
ষষ্ঠদশ শতকে মুঘল শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার নন্দিত মসলিন হয়ে ওঠে সৃজনসৌকর্যে উৎকৃষ্ট নকশাদার জামদানি। পারসিক মোটিফের সঙ্গে বাংলার নিসর্গের ফুল-ফলের নকশা সংযোজন করে বয়নশিল্পীরা জামদানিকে শিল্পোতীর্ণ করে তোলেন।
২০১৩ সালে ইউনেস্কো ‘ইনট্যান্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ এর মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করেছে 'জামদানি'কে।
জামদানির নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মত রয়েছে। একটি মত অনুসারে, ‘জামদানি’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফার্সি জামা অর্থ কাপড় এবং দানা অর্থ বুটি, সে অর্থে জামদানি অর্থ বুটিদার কাপড়। এ কারণে মনে করা হয় মুসলমানেরাই ভারত উপমহাদেশে জামদানির প্রচলন ও বিস্তার করেন। আরেকটি মতে, ফারসিতে ‘জাম’ অর্থ এক ধরনের উত্কৃষ্ট মদ এবং ‘দানি’ অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকির পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উত্পত্তি ঘটেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে বঙ্গদেশ থেকে সোনারগাঁ বন্দরের মাধ্যমে মসলিনের মতো সূক্ষ্ম-বস্ত্র ইউরোপে রপ্তানি হতো। তবে ‘মসলিন’ শব্দটির উৎপত্তি সম্ভবত ইরাকের মৌসুল শহর থেকে। আর জামদানি শব্দটি এসেছে পারস্য থেকে।
বুটিদার জামা থেকে জামদানি শব্দটি পাঠান সুলতানদের আমলে বাংলায় প্রবেশ করে। নবম শতকে আরব ভূগোলবিদ সুলেমান বাংলাদেশের মসলিন ও জামদানি বস্ত্রের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থে। প্রখ্যাত পর্যটক ইবনবতুতা চোদ্দোশো শতকে লেখা তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে সোনারগাঁ- এর বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করতে গিয়ে মসলিন ও জামদানির কথা বলেছেন। মুঘল আমলে মসলিন ও জামদানি শিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়।
সে সময় মসলিন ও জামদানি দিল্লি, লখনউ ও মুর্শিদাবাদে চড়াদামে বিক্রি হতো। মসলিন কাপড় এত সূক্ষ্ম ছিল যে, একটি আংটির ভেতর দিয়ে পুরো একটি মসলিনের শাড়ি টেনে নিয়ে যাওয়া যেত। জামদানি বিখ্যাত ছিল তার বিচিত্র নকশার কারণে। প্রতিটি নকশার ছিল ভিন্ন ভিন্ন নাম। পান্নাহাজার, বুটিদার, দুবলিজাল, তেরসা, ঝালর, ময়ূরপাখা, কলমিলতা, পুইলতা, কল্কাপাড়, কচুপাতা, আঙুরলতা, প্রজাপতি, শাপলাফুল, জুঁইবুটি, চন্দ্রপাড়, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুল—এমনি নানা রকম নাম ছিল এসব নকশার।