দেবীর নাম, 'ষষ্ঠী'। কেন?
'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-এ বিষ্ণু বলছেন যে, ষষ্ঠী দেবী প্রকৃতির ষষ্ঠ অংশ থেকে জন্ম নিয়েছিলেন। তাই তিনি 'ষষ্ঠী' নামে অভিহিতা হন। দেবলোকে তাঁর আর এক নাম, 'দেবসেনা'। তিনি দেবসেনাপতি কার্তিকেয়র পত্নী। (অন্য সব পুরাণ-মতে কার্তিক চিরকুমার হলেও 'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ' ও 'মহাভারত' অনুসারে তিনি কিন্তু বিবাহিত)।
দেবী ষষ্ঠীর পুজো কীভাবে প্রচলিত হল?
'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-এ বিষ্ণুর বয়ানে এই প্রসঙ্গে একটি গল্প আছে। সেটাই একটু গুছিয়ে বলছি, শুনুন:
স্বায়ম্ভুব মনুর পুত্র প্রিয়ব্রত সমগ্র পৃথিবীর (কিংবা, ত্রিলোকের) রাজা হলেও তাঁর রাজকাজে একেবারেই মন নেই। সংসারেও মন নেই। আর সে-কারণেই তিনি বিবাহও করেননি। সারাক্ষণ খালি জপে-তপে-ধ্যানে-জ্ঞানে মগ্ন থাকেন।
প্রিয়ব্রতর এই বৈরাগ্য দশা দেখে পরমপিতা ব্রহ্মা নড়েচড়ে বসলেন। তিনি স্বয়ং প্রিয়ব্রতর কাছে এসে বললেন, বাপু হে, তুমি রাজা হয়েছ, অথচ রাজকার্য করছ না; তুমি পুরুষ হয়েও সংসার করছ না--এমনধারা সৃষ্টিবিরুদ্ধ কাজ মনুর পুত্র হয়ে কি তোমায় মানাচ্ছে! তোমার বৈরাগ্য হয়েছে, ভালো কথা। সংসার করে, অপত্য আনয়ন করেও তো ঋষিরা বৈরাগ্য লালন করেন; তুমিও না-হয় তেমন করো। হে পুত্র, সৃষ্টিকে সাগ্রসর করতে অবিলম্বে সংসার কর!
ব্রহ্মার এমন সস্নেহ ভর্ৎসনায় প্রিয়ব্রত লজ্জিত হলেন। এবং, অবিলম্বেই ব্রহ্মাবাক্য শিরোধার্য করে মালিনী নামের এক সুলক্ষণা কন্যাকে বিবাহ করে ফেললেন।
দিনের পরে দিন যায়। কিন্তু, রানি মালিনী কিছুতেই আর সন্তানবতী হন না। প্রিয়ব্রত এই নিয়ে যখন বেশ দুশ্চিন্তিত হয়ে উঠেছেন, তখন একদিন মহর্ষি কশ্যপ তাঁর সহায় হলেন। তিনি পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করে যজ্ঞের পায়েস দেবব্রতর হাতে দিয়ে বললেন মালিনীকে খাইয়ে দিতে।মালিনী খেলেন এবং অচিরেই গর্ভবতী হলেন।
দশ মাস কেটে গেল, এগারো মাস কেটে গেল, বছর ঘুরে গেল, তবু কিন্তু প্রসব হল না। শুরু হল অপেক্ষার দিন।
তারপর যখন বারো বছর পূর্ণ হল, তখন মালিনী একদিন প্রসব করলেন একটি পুত্রসন্তান। পুত্র সর্বগুণলক্ষণযুক্ত, কিন্তু মৃত। ফলে, রাজপুরী যেখানে আনন্দের বানে ভেসে যাওয়ার কথা, সেখানে তা ডুবে গেল শোকের সাগরে।
অন্তঃপুরে কান্নার রোল উঠল। রানি বার বার মূর্ছা যেতে লাগলেন। প্রিয়ব্রত শোকে একেবারে মুহ্যমান হয়ে গেলেন। হায় হায়, তাঁর এমন অপেক্ষার ধন এভাবে হারিয়ে গেল!
সেই মুহ্যমান অবস্থাতেই প্রিয়ব্রত ঠিক করলেন, নিজের হাতে সন্তানের সৎকার করবেন। তাই পরমযত্নে তাকে বুকে করে নিয়ে গেলেন নদীচরের শ্মশানে।
কিন্তু, পারলেন না তাকে বুকের আশ্রয়হারা হতে দিতে। শেষ বিদায় দিতে গিয়ে নিদারুণ অতৃপ্ত অপত্যস্নেহে বার বার পুত্রের মুখ দেখতে লাগলেন, চুমু খেতে লাগলেন, আর অঝোরধারায় কাঁদতে লাগলেন।
না না, পুত্রের সৎকার তিনি করতে পারবেন না! এর চেয়ে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়া সহজ। হ্যাঁ, তাই ভালো। এমন অতৃপ্ত পিতৃত্ব নিয়ে বেঁচে থেকেই বা হবে কী!
প্রিয়ব্রত আপন তরবারি কোষমুক্ত করে নিজেকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন; কিন্তু সেই মুহূর্তেই, শাদা অথচ নানাবিধ রত্নখচিত রথে এক দেবীকে আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে থমকে গেলেন।
সাদা চাঁপাফুলের মতো দেবীর গায়ের রঙ, পরনে ক্ষৌমবস্ত্র, অঙ্গে ফুলমালার সজ্জা, মুখে প্রসন্নময়ীর হাসি। দেবীকে একেবারে সামনে দেখে প্রিয়ব্রত কেমন যেন হয়ে গেলেন। বুকের সন্তান মাটিতে নামিয়ে করজোড়ে বন্দনা করে বললেন, হে দেবী, আপনি কে?
দেবী বললেন যে, তিনি ব্রহ্মার মানসকন্যা। কার্তিকের পত্নী। দৈত্যদের বিরুদ্ধে একবার নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন বলে, তাঁকে 'দেবসেনা' বলা হয়। প্রকৃতির ষষ্ঠ অংশ থেকে তাঁর জন্ম। তাই তাঁকে সকলেই 'ষষ্ঠী' বলে ডাকে--
'ব্রহ্মণোমানসীকন্যা দেবসেনামহীশ্বরী।
সৃষ্ট্বা মাং মনসোধাতা দদৌস্কন্দায ভুমীপ।।
মাতৃকাসুচ বিখ্যাতা স্কন্দসেনা চ সুব্রতা।
বিশ্বে ষষ্ঠীতি বিখ্যাতা ষষ্ঠাংশা প্রকৃতের্যতঃ।।
[৪৩তম অধ্যায়, ২৫--২৬ সংখ্যক শ্লোক।]
('পুরাণ' আসলেই গোঁজামিলের গল্প। এখানে গোঁজামিলটা হচ্ছে, ষষ্ঠী যদি ব্রহ্মার মানসকন্যা হন, তাহলে প্রকৃতির অংশজাতা হন কী করে? মানসপুত্র বা কন্যারা মন থেকে জন্ম নেন, সেখানে প্রজনন বা অংশের প্রয়োজন হয় না; পুরুষের প্রকৃতি বা প্রকৃতির পুরুষকে প্রয়োজন হয় না।)
যাই হোক, দেবী আরও বললেন যে, তিনি পুত্রহীনকে পুত্র দেন, প্রিয়হীনকে প্রিয়বস্তু দেন, দারিদ্রকে ধন দেন এবং ক্রিয়াহীনকে শুভকর্মের দিশা দেখান। এসব কথা বলতে বলতেই দেবী প্রিয়ব্রতর মৃতপুত্রকে কোলে নিয়ে তাকে হঠাৎ বাঁচিয়ে দিলেন। তারপর তাকে কোলে নিয়েই রথে চেপে স্বর্গের দিকে উড়ান দিলেন।
আচম্বিতে এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখে প্রথমটায় প্রিয়ব্রত হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারপর হুঁশ ফিরতেই পুত্রকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ক্রমান্বয়ে কাকুতিমিনতি করতে লাগলেন। পরিশেষে দেবীর স্তব শুরু করলেন।
তখন দেবী তুষ্ট হয়ে স্থির হলেন। বললেন, হে প্রিয়ব্রত, তুমি স্বয়ম্ভুব মনুর পুত্র, সমগ্র চরাচরের অধীশ্বর; তুমি যদি ধরায় আমার পূজার প্রচার করো, প্রচলন করো তাহলে তোমার সন্তান তোমায় ফিরিয়ে দেব। আমার বরে তোমার পুত্র সকল বিষয়ে গুণবান হবে, পৃথিবীতে 'সুব্রত' নামে বিখ্যাত হবে।
অমনি প্রিয়ব্রত আনন্দের সঙ্গে কথা দিলেন যে, তিনি অবিলম্বেই দেবীর পূজাবিস্তারের ব্যবস্থা করবেন। তাঁর এই সংকল্পে হৃষ্ট হয়ে পুত্র অর্পণ করে দেবী সানন্দে স্বর্গে ফিরে গেলেন।
সপুত্র প্রাসাদে ফিরে প্রিয়ব্রত নিজে যেমন দেবীর পুজো শুরু করলেন, তেমনি দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করে ও সকলকে উৎসাহিত করে ধীরে ধীরে সমগ্র ধরাধামে ষষ্ঠী পুজোর প্রসার ঘটিয়ে ফেললেন।
আচ্ছা সে তো হল, কিন্তু কোন মাসের কোন দিন দেবী ষষ্ঠীর পুজো করা যায়?
পঞ্জিকা মতে, বৈশাখ, আষাঢ়, কার্তিক আর ফাল্গুন মাস বাদ দিয়ে বাকি আট মাসের শুক্ল ষষ্ঠী তিথিতেই দেবী ষষ্ঠীর পুজো করা যায়।
সনাতন পুরাণের সঙ্গে লোকপুরাণ মিশে গিয়ে কালে কালে গড়ে উঠেছে ষষ্ঠীর নানান রূপ। এবং, এক এক রূপের একাধিক প্রচারমূলক গল্প অর্থাৎ ব্রতকথাও রচিত হয়েছে। প্রচারিত হয়েছে দেবীর নানান নাম। যেমন:
জৈষ্ঠ্য মাসে দেবীর নাম 'অরণ্য ষষ্ঠী';
শ্রাবণে 'লুণ্ঠন বা লোটন ষষ্ঠী';
ভাদ্রে 'চাপড়া বা মন্থন ষষ্ঠী';
আশ্বিনে 'দুর্গা ষষ্ঠী বা বোধন ষষ্ঠী';
অঘ্রানে 'মুলা ষষ্ঠী';
পৌষে 'পাটাই ষষ্ঠী';
মাঘে 'শীতল ষষ্ঠী';
চৈত্রে 'অশোক ষষ্ঠী' ও 'নীল ষষ্ঠী'।
'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-এ কিন্তু অমন বাছবিচার নেই। সেখানে সব মাসের শুক্ল ষষ্ঠীতেই ষষ্ঠী পুজোর বিধান রয়েছে--
"রাজা চ প্রতি মাসেষু শুক্ল ষষ্ঠ্যাং মহোৎসবং।
ষষ্ঠ্যাদেব্যাশ্চ যত্নেন কারয়ামাস সর্ব্বতঃ।।
(৪৩তম অধ্যায়, শ্লোক-৪৪)
অর্থাৎ, রাজা প্রিয়ব্রত ষষ্ঠী দেবীর পূজা এবং মহোৎসব করেছেন প্রতি মাসেই।
এবার কথা হচ্ছে, জৈষ্ঠ্য মাসে 'অরণ্য ষষ্ঠী'-তে জামাই ডেকে দারুণ খাতির করে যে 'জামাই ষষ্ঠী' করা হয়, সেটা কেন করা হয়? এদিন মেয়ে ষষ্ঠী করা হয় না কেন?
পুরাণ বলুন বা মহাকাব্য, সেখানে সকলেই উত্তরাধিকারী হিসেবে চায় পুরুষকে। পুত্রসন্তানকে। তাই পুত্র-ইষ্টি যজ্ঞ হয়, কন্যা-ইষ্টি যজ্ঞ হয় না। পুরুষতন্ত্রের মূল কথাই হল নারীকে দমিয়ে রাখা; পিতৃতন্ত্রের মূল কথা, মায়েদের দমিয়ে রাখা।
শাস্ত্র পুরুষের তৈরি। পুরাণ পুরুষের লেখা। সেখানে নারীরাও পুরুষের ভাবনা-পথেই আচরণ করেন। দেবীও।
তাই দেবী যখন নিজের মাহাত্ম্যের কথা প্রিয়ব্রতকে বললেন, তখন একবারও বললেন না যে, সন্তানহীনকে সন্তান দেন বা কন্যাহীনকে তিনি কন্যা দেন! বললেন যে, পুত্রহীনকে পুত্র দেন-
"অপুত্রায় পুত্রদাহং প্রিয়দাতা প্রকৃতের্যতঃ।
ধনধাচ দরিদ্রেভ্যো কর্ম্মিণে শুভকর্ম্মদা।।
(৪৩তম অধ্যায়, শ্লোক-২৭)
তাই 'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ' অনুসারে ষষ্ঠী হচ্ছেন পুত্রসন্তান প্রাপ্তি এবং তাকে সুরক্ষিত রাখার দেবী। কন্যাসন্তান তাঁর কাছে উপেক্ষিত। তাই প্রিয়ব্রতের গল্পটিও লেখা হয়েছে মৃত পুত্রসন্তান প্রাপ্তি এবং তাকে দেবীকর্তৃক জীবনদান করার ঘটনার আধারে।
এই শাস্ত্রীয় পুরাণসৃষ্ট দেবী ষষ্ঠী অবশ্য একদা লৌকিকধারার মধ্যে পড়ে ক্রমে (লোকপুরাণ-এর ব্রতকথাধারাটি একান্তভাবেই নারীর হাতে তৈরি, তাই) পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে শিশুমঙ্গলের দেবী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু, নারীরা পুরুষতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ টানটা একেবারে বিলোপ করতে পারেননি, তারই প্রমাণ 'জামাই ষষ্ঠী'।
আসলে, 'জামাই ষষ্ঠী'র সরাসরি শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক কোন ভিত্তি নেই। লোকপুরাণেও এ-নিয়ে কোন ব্রতকথা নেই।
সুতরাং, এই ব্যাপারটি অনেক পরবর্তীকালের সংযোজন। 'জামাই ষষ্ঠী' প্রাচীন হলে, এই ব্রত নিয়ে একখানা নিটোল গল্প নিশ্চিত লেখা হত মৌখিক সাহিত্য ও ব্রতকথায়। তাই এর উদ্ভব সম্পর্কে নিশ্চিত ইতিহাস নেই। ফলে, আলোচনায় আমাদের নিছক অনুমানের হাত ধরতে হবে।
আমাদের অনুমান, পৌরাণিক ভাবনায় যেহেতু পুত্রসন্তান অর্থাৎ উত্তরাধিকারীর মঙ্গল কামনায় এই ব্রত করা হত, তাই একটা সময় ব্রতের উদযাপনে পুত্রের উপস্থিতি সম্ভবত অত্যন্ত আবশ্যিক ছিল--অন্তত বছরের প্রথম ব্রতটিতে।
তাই, যাঁদের ঔরসজাত পুত্র ছিল না, তাঁরা দত্তকপুত্র গ্রহণ না করলে ঘরজামাই বা পর-জামাইকেই উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করতেন এবং আপন পুত্রের সম্মান দিতেন। (এখনও দেন)। সুতরাং, জৈষ্ঠ্য মাসের ব্রতটিতে অপুত্রক শ্বশুর-শ্বাশুড়ির আহ্বানে ঘরজামাই বাড়তি গুরুত্ব পেতে শুরু করেন এবং পর-জামাই শ্বশুরবাড়িতে হাজির হয়ে অংশ নিতে শুরু করেন।
আমাদের অনুমান, জামাই ষষ্ঠীর প্রাথমিক রূপটি এটিই ছিল-পরবর্তীতে যা সার্বজনীন হয়ে ওঠে। স্রোত-সংস্কৃতির বিবর্তন ও বিবর্ধন যেভাবে হয়, সেভাবেই এটা হয়েছে।
শেষ কথায় বলি, সমাজ যতই এগিয়ে যাক না কেন, পৌরাণিক পুরুষতন্ত্র ও পুরুষতান্ত্রিক উদ্দেশ্য জৈষ্ঠ্যের ষষ্ঠী ব্রত এখনও ধরে রেখেছে বলেই আজও 'জামাই ষষ্ঠী' হয়, 'মেয়ে ষষ্ঠী' হয় না।