'অরণ্য ষষ্ঠী' থেকে 'জামাই ষষ্ঠী'র ইতিবৃত্ত

 

আজ বাসে উঠেছি অফিস রওনা দেব বলে, কানে এল বাসের চালক আর খালাসির কিছু 'দামি' কথাবার্তা। চালক মহাশয় খালাসিকে বেজায় আক্ষেপ করে বলছেন যে, 'কোথায় আজ ভাল-মন্দ পেটপুরে খাব তা না, সকাল সকাল স্টিয়ারিং হাতে পাবলিক সামলাতে হচ্ছে। ধুর! শহরে এসব নিয়ে যেন কোনও মাথা ব্যাথা নেই, আমাদের দেশগাঁ হলে দেখতি ঘরে ঘরে কত রান্নাবান্না-হৈ হৈ ব্যাপার। এখেনে আজকাল এসব পাত্তা দেয় না কেউ'। যা বলেছেন তাতে এই দাঁড়ায় যে, তিনি খুবই আহত এমন একটা সরস দিনে 'ডিউটি' পালন করতে হচ্ছে বলে। ছুটি না পেয়ে 'শহুরে জামাই ষষ্ঠী'কে এক তরফা গালমন্দ তিনি করেছেন বটে তবে এখনও শহর হোক বা গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে মহাসমারোহে চলে জামাই বন্দনা। জানেন কি, বাংলার আবেগের সঙ্গে মিশে যাওয়া এই দিনটি অর্থাৎ 'জামাই ষষ্ঠী' তা কিন্তু আদতে 'অরণ্য ষষ্ঠী'। কীভাবে এল এই পরিবর্তিত ধারা?

 

জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে বিবাহিত মেয়ের মায়েরা জামাই সহ মেয়েকে নিমন্ত্রণ করে দইয়ের ফোঁটা ও চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় সহকারে অভ্যর্থনা জানিয়ে এবং উপহারের আদান প্রদানে 'জামাই ষষ্ঠী' বা 'অরণ্য ষষ্ঠী' পালন করে থাকেন, এ দেশে এমনটাই রীতি চলে আসছে গত কয়েক শতক ধরে। কথিত আছে, অর্জুন অরণ্য বাসের সময় গন্ধর্ব মতে মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করেছিলেন। এইদিন অর্জুন- চিত্রাঙ্গদার রাজবাড়িতে অভ্যর্থিত হন। তাই এই দিনটি 'অরণ্য ষষ্ঠী' নামে পরিচিত।

ধর্মীয় ভাবে এই দিনটি বেশি পালিত হয় অরণ্যষষ্ঠী হিসেবে। তবে মনে রাখতে হবে ষষ্ঠী দেবী শুধু বাঙালির পূজ্যা নন, তিনি সর্বভারতীয়। মা ষষ্ঠী নিছক বাংলার এক গ্রামদেবী নন, মঙ্গলকাব্যের অপর দুই দেবী শীতলা ও মনসার মতোই তিনিও ভারতের নানা অঞ্চলে পূজিত হন। ষষ্ঠী ব্রতর কাহিনিটিও খুব বার্তাবহ। এক যৌথ পরিবারের ছোট বউ রোজ খাবার চুরি করে আর একটা কালো বেড়ালের নামে দোষ দেয়। বেড়ালটা এর প্রতিশোধ নিতে সেই ছোট বউয়ের বাচ্চা হলেই তাকে তুলে নিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে লুকিয়ে রেখে আসত। বউটি তা জানতে পেরে দেবীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করল। মা ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করলেন দুই শর্তে। বললেন, এই দিন তাঁর পুজো করতে হবে এবং কালো বেড়ালকে তাঁর বাহন হিসেবে সম্মান করতে হবে।

বায়ুপুরাণে ষষ্ঠী ৪৯টি দেবীর অন্যতম, আর একটি পুরাণে তাঁকে ‘সমস্ত মাতৃদেবীর মধ্যে আরাধ্যতমা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে মা ষষ্ঠী স্কন্দদেবের পালিকা-মা ও রক্ষয়িত্রী। পদ্মপুরাণেও তিনি স্কন্দের স্ত্রী। দেবী ষষ্ঠীর কাহিনিগুলি পাওয়া যায় বাংলায় মঙ্গলকাব্যে। ষষ্ঠীমঙ্গলে সর্পদেবীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। অন্য রাজ্যেও ষষ্ঠী পূজার সঙ্গে সন্তান জন্মের সম্পর্ক রয়েছে। বিহারে সন্তানজন্মের পরে ছ’দিনের অনুষ্ঠানটিকে ছ’ঠী বলা হয়, ষষ্ঠী সেখানে ছ’ঠী মাতা, সন্তানহীনা দম্পতিরা তাঁর আরাধনায় ব্রত পালন করেন, ষষ্ঠী ব্রত। ওডিশায় সন্তানজন্মের ছ’দিন এবং একুশ দিনে এই দেবী পূজিত হন। উত্তর ভারতের কোথাও কোথাও বিয়ের সময়েও ষষ্ঠীর পুজো করা হয়। বাংলাতেও অনেকের মধ্যে ষষ্ঠী পালনের রেওয়াজ রয়েছে।

এছাড়া, ষষ্ঠী দেবীর মূর্তি পূজা হয় পূর্ববঙ্গে। মার্জারবাহিনী ষষ্ঠীর কোলে এক বা একাধিক শিশু। দুধ পুকুরের সামনে বট গাছের নীচে তাঁর অধিষ্ঠান। ষষ্ঠীকে আবার অমঙ্গলের দেবী বলা হয়েছে, তিনি কুপিত হলে মা ও শিশুদের দুঃখ দেন। কাশ্যপ সংহিতায় ষষ্ঠীকে বলা হয়েছে ‘জাতহরণী’, যিনি মাতৃগর্ভ থেকে ভ্রূণ অপহরণ করেন, সন্তান জন্মের ছ’দিনের মধ্যে তাকে ভক্ষণ করেন, তাই শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে ষষ্ঠ দিনে তাঁকে পুজো করা বিধেয়।

এসবের মধ্যেই কখন যেন জাঁকিয়ে বসেছে জামাই ষষ্ঠী। লোকাচার বিষয়ক গবেষকদের মতে, আঠারো-উনিশ শতকে বাংলায় বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বালবিধবা সমস্যা তখন মারাত্মক। এই অবস্থায় জামাই ও স্বামীর দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা বাঙালি মা এবং মেয়ের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর তার থেকেই অরণ্য ষষ্ঠী হয়ে ওঠে জামাইকে আপ্যায়নের পরব।

ঐ বাস চালকের কথা অবশ্য পুরোটা জলে দেওয়ার মতো নয়। 'এখেনে আজকাল এসব পাত্তা দেয় না কেউ'-এই কথার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আংশিক সত্যতা। কারণ হিসেবে দোষ চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে 'ব্যস্ততা' আর 'বিভিন্ন খাবারবাহিত রোগ' -এর উপর। সমাজ-স্বাস্থ্যে যেভাবে সুগার, ব্লাডপ্রেসার, কোলেস্টোরল জাঁকিয়ে বসেছে তাতে জামাই বাবাজীবনদের ষোলকলা পূর্ণ করে খাওয়া বা খাওয়ানোতে খানিক 'রেস্ট্রিকশন'এর প্রকোপ তো পড়েছেই। কিন্তু এসবের পরেও জামাই ষষ্ঠীর জাঁকজমক ও গুরুত্ব মোটেও কম নয়। এখনও বাঙালির একেবারে ঘরোয়া এই অনুষ্ঠানে চলে ব্রত পালন, যেখানে শাশুড়ি মা বিভিন্ন উপাচার সাজিয়ে পুজো দেন, তারপর ধান- দূর্বা দিয়ে জামাইকে আশীর্বাদ করে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন। জামাই বাবাজীবনকে তুষ্ট করার জন্য যথাসাধ্য আয়োজন করা হয় সঙ্গে চলে তালপাতার পাখার হাওয়া। জামাই ষষ্ঠীর অন্যতম অংশ কিন্তু এই তালপাতার হাতপাখা।

জৈষ্ঠ মাসের প্রখর গরমে শরীর জন্য শুরুতে থাকে নানারকম সরবত সঙ্গে মরশুমী ফল যেমন পাকা আম, কাঁঠাল কোয়া, কলা, লিচু সাথে এক জামবাটি ঘন ক্ষীর দুধ। দুপুরেও থাকে এলাহী আয়োজন। পাঁচ দশ রকম পদ সাজিয়ে শাশুড়ি মা যত্ন করে সামনে বসিয়ে খাওয়ান জামাইকে। ভাত/ পোলাও/ ঘি- ভাত সঙ্গে বেশ কয়েক রকম ভাজা, কয়েকটা নিরামিষ পদ, মাছের পদ(ভাপা, ঝোল, ঝাল, মালাইকারি), পাঁঠার মাংস, শেষ পাতে পায়েস, মিষ্টি; সাধারনত এগুলির মধ্যেই ঘোরাফেরা করে 'মেনু'সমূহ।

জামাই ষষ্ঠী আয়োজনের উদ্দেশ্য হল জামাইয়ের 'পেট' জয়ের সাথে সাথে মন জয় করা যাতে শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের আদর আপ্যায়নও থাকে অটুট, সাথে হয়ে যায় একটা ছোটখাটো পারিবারিক সম্মেলনও, যা এই 'নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি কনসেপ্ট' যুগে ভালো বই মন্দ নয়। সময় বদলেছে, শাশুড়ি জামাই সবাই এখন কর্মব্যস্ত, তাই অন্ততঃ একটা দিন সব কাজ ভুলে খাওয়া দাওয়া- হাসি মজায় সবাই মেতে উঠে সম্পর্কের বাঁধনটা আরও একটু পোক্ত করে নেওয়াই যায় 'জামাই ষষ্ঠী'র মিলন পরবে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...