রক্তে লেখা জালিয়ানওয়ালাবাগ

দিনটা বৈশাখী। পঞ্জাবী মানুষের নববর্ষ। গুরুগোবিন্দ সিংহের খালসা পন্থ প্রতিষ্ঠার দিন। চারপাশের অস্থিরতার মধ্যেও উৎসবের ছোঁয়া মনে। যদিও আইন, কার্ফু আর কখন কী হয় ভয় আছেই, কিন্তু তা’বলে থেমে নেই মানুষ। প্রার্থনা-আনন্দ তো আছেই, তা বাদেও তাছাড়া সেই দিনটাকে অন্যভাবে কাজে লাগানো যাক। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ১৩ এপ্রিল। সাল ১৯১৯।

ওই বছরেরই মার্চ মাসের ১০ তারিখ জারি করা হয়েছে কুখ্যাত রাওলাট আইন। বৈশাখীর দিনটিকে বেছে নেওয়া হল  জনগণের কণ্ঠ ও অধিকাররোধকারী এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে।

jali-1

প্রতিবছর এই দিনটায় অমৃতসরে প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। গোটা শহরজুড়ে হইহই আনন্দ। আশপাশের গ্রাম থেকে  অমৃতসরে জড়ো হয় মানুষ। গুরুদোয়ারায় ভিড় করে। কিন্তু এবার আবহাওয়া যেন খানিক আলাদা। শহরে জমায়েত নিষিদ্ধ। অমৃতসর তখন দেশের সশস্ত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। ব্রিটিশ শাসকদের কড়া নজরে বন্দী। জেনারাল রেজিনাল্ড ডায়ারকে অমৃতসরে পাঠানো হয়েছিল পঞ্জাব নিয়ন্ত্রণের জন্য।  

ঠিক বিকেল পাঁচটায় সেদিন এক নাগরিক জমায়েত। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির বা হরিমন্দির সাহিবের ঠিক পাশেই। জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে। উদ্যানটি মহারাজা রণজিৎ সিংহের আমলের অভিজাত জালিয়ানওয়ালা পরিবারের সম্পত্তি। পারিবারিক নাম অনুসারেই উদ্যানের নাম জালিয়ানওয়ালাবাগ।

উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাগান। বেরবার পথ বলতে সরু একটা গলি। একদিকে কুয়ো আর একদিকে সুফি কবরখানা।

১৯১৯-এর বৈশাখীতে মানুষ কার্ফুবন্দী। জেনারেল ডায়ারের কড়া হুকুম চলছে সকাল থেকে। তবু উদ্যানে তবু জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে জমায়েত হল। সংখ্যায় প্রায় ২০ হাজারের ওপর।

jali-2

নির্ধারিত সময়ে শুরু হল সভা। আগে থেকে ইংরেজ সিপাহী বা রাজপুরুষদের দাপাদাপি নেই বলে বেশ ভয়হীন।

ঠিক সেই সময় ধেয়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। পালাবার পথ নেই। বেরবার পথ বন্ধ।  আচমকা বুলেট আক্রমণে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে একটার পর একটা দেহ। নারী, শিশু, পুরুষ, বৃদ্ধ কেউ বাকি নেই...

প্রাণ বাঁচাতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে ভয় পাওয়া জনতা। কেউ কেউ ওঠার চেষ্টা করছে দেওয়াল বেয়ে। চিৎকার, কান্না, মাঠ জুড়ে রক্তের স্রোত আর মানুষের কাতরানি...

ব্রিটিশের গুলিতে নিহত প্রায় ১৫০০ নিরস্ত্র নির্দোষ ভারতীয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা সাঁজোয়া গাড়ি, মেশিনগান, রাইফেল ব্যবহার করে ঠাণ্ডা মাথায়, পরিকল্পিতভাবে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল।   

jali-4

গণহত্যার সেই খবর আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দেশ। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করলেন। ৩০ মে বড়লাটকে তিনি চিঠি দিলেন। তিনি লিখলেন, “অদ্যকার দিনে আমাদের ব্যক্তিগত সম্মানের পদবিগুলা চতুর্দিকবর্তী জাতিগত অবমাননার অসামঞ্জস্যের মধ্যে নিজের লজ্জাকেই স্পষ্টতর করিয়া প্রকাশ করিতেছে, অন্তত আমি নিজের সম্বন্ধে এই কথা বলতে পারি যে, আমার যে সকল স্বদেশবাসী তাহাদের অকিঞ্চিৎকরতার লাঞ্জনায় মানুষের অযোগ্য অসম্মান সহ্য করিবার অধিকারী বলিয়া গণ্য হয়, নিজের সমস্ত বিশেষ সম্মান চিহ্ন বর্জন করিয়া আমি তাহাদের পার্শ্বে নামিয়া দাঁড়াইতে ইচ্ছা করি।”

জেনারেল ডায়ার হয়ে উঠেছিল প্রায় প্রতিটি ভারতবাসীর শত্রু। কিন্তু ইংল্যান্ডে তিনি বীর। ডায়ারের সমর্থনে তৈরি তহবিলে ২৬ হাজার পাউন্ড সংগৃহীত হয়েছিল। ইংল্যান্ডে ফেরার পর রত্ন তরবারী উপহার দেওয়া হয়। তাতে লেখা ছিল ‘স্যাভিয়র অফ পঞ্জাব’।

জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল ব্রিটিশ সরকার। সেই কমিটির কাছে ব্রিগেডিয়ার ডায়ার বলেছিলেন, “আমি মনে করি যা করেছি ভাল করেছি...”    

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...